শ্বসন (Respiration)
প্রত্যেক জীবদেহে দিবারাত্র জৈবিক প্রক্রিয়া বা বিপাকীয় ক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। এইসব জৈবিক ক্রিয়াগুলি নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য প্রয়োজন শক্তির। শ্বসনের ফলেই জীবদেহে খাদ্যবস্তু জারিত হয়ে শক্তি উৎপন্ন করে। অর্থাৎ খাদ্যসহ শক্তির মুক্তি ঘটে। এই শক্তি ব্যয়িত হয়েই জীবের বিভিন্ন জৈবিক ক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। সুতরাং সমস্ত জীবের পক্ষে শ্বসন অপরিহার্য।
শ্বসনের সংজ্ঞা: যে অপচিতি জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অনুপস্থিতিতে উৎসেচকের সহায়তায় কোশের মধ্যে খাদ্য জারিত হয়ে সরলতম অংশে বিশ্লিষ্ট হয় এবং খাদ্যস্থ রাসায়নিক শক্তি গতি বা তাপ শক্তিতে ধীরে ধীরে রূপান্তরিত বা মুক্ত হয় এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়, তাকে শ্বসন বলে।
শ্বসন হল একরকমের অপচিতিমূলক বিপাক প্রক্রিয়া।
যে বিপাক ক্রিয়ায় জীবের শুষ্ক ওজন হ্রাস পায় তাকে অপচিতি বিপাক বলা হয়। শ্বসন প্রক্রিয়ায় জটিল খাদ্যবস্তু বিশ্লিষ্ট হয়ে সরল উপাদানে পরিণত হয় এবং জীবদেহের শুষ্ক ওজন হ্রাস পায় ও শক্তির মুক্তি ঘটে, তাই শ্বসনকে এক ধরনের অপচিতি বিপাক বলে।
সবাত শ্বসন: যে শ্বসন পদ্ধতিতে বায়ুজীবী জীবকোশে শ্বসন বস্তু (গ্লুকোজ) মুক্ত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে সম্পূর্ণরূপে জারিত হয়ে জল এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয় এবং শ্বসন বস্তু-মধ্যস্থ শক্তি সম্পূর্ণরূপে নির্গত হয়, তাকে সবাত শ্বসন বলে।
C₆H₁₂O₆+ 6O₂ — 6CO₂ + 6H₂O + 686 kcal
এককোশী প্রাণী অ্যামিবা থেকে শুরু করে উন্নত শ্রেণির বহুকোশী উদ্ভিদ এবং প্রাণীদেহের প্রতিটি সজীব কোশে এই রকম শ্বসন সংঘটিত হয়।
সবাত শ্বসন বায়ুজীবী কোশে দুটি পর্যায়ে ঘটে। এই পর্যায় দুটি (i) গ্লাইকোলাইসিস এবং (ii) ক্রেবস-চক্র।
গ্লাইকোলাইসিস: এই পর্যায়ে কোশের সাইটোপ্লাজমে এক অণু গ্লুকোজ O₂ ছাড়াই বিভিন্ন উৎসেচকের সহায়তায় কয়েকটি ধাপে আংশিকভাবে জারিত হয়ে 2 অণু পাইরুভিক অ্যাসিড, 2 অণু ATP ও 2 অণু NADH₂ উৎপন্ন করে।
গ্লুকোজ থেকে পাইরুভিক অ্যাসিড তৈরির ধাপগুলি এম্বডেন, মেয়ারহফ ও পারনাস আবিষ্কার করেন বলে একে EMP পথ বলে।
ক্রেবস চক্র: এই পর্যায়টি কোশের মাইটোকনড্রিয়ায় ঘটে। গ্লাইকোলাইসিসে উৎপন্ন পাইরুভিক অ্যাসিড এর পর অ্যাসিটাইল কো-এ তে পরিণত হয়। এই অ্যাসিটাইল কো-এ অক্সালোঅ্যাসিটিক অ্যাসিডের সঙ্গে বিক্রিয়া করে সাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে এবং ক্রেবস চক্রের মাধ্যমে জারণ শুরু করে। এই জারণ বিক্রিয়ায় কার্বন ডাই অক্সাইড, জল ও 686K. Cal. শক্তি উৎপন্ন হয়। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন উৎসেচকের সহায়তায় ধাপে ধাপে চক্রাকারে ঘটতে থাকে। সবাত শ্বসনের এই প্রক্রিয়াটিক ক্রেবস চক্র বলে।
অবাত শ্বসন: যে শ্বসন প্রক্রিয়ায় অবায়ুজীবী জীবের (যেমন—অন্তঃপরজীবী, এককোশী ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া প্রভৃতি) কোশমধ্যস্থ খাদ্যবস্তু (গ্লুকোজ) মুক্ত অক্সিজেনের অনুপস্থিতিতে কিন্তু অক্সিজেনযুক্ত যৌগের অক্সিজেনের উপস্থিতিতে আংশিকভাবে জারিত হয়ে কার্বন ডাইঅক্সাইড, জল ও বিভিন্ন অজৈব অক্সাইড (যেমন—নাইট্রাইট) ও অল্প পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে, তাকে অবাত শ্বসন বলে।
C₆H₁₂O₆ + 12NO₃ — 6CO₂ + 6H₂O + 12NO₂ + 50 kcal
শ্বসনের তাৎপর্য: (ক) শ্বসনের মাধ্যমে খাদ্যস্থিত স্থিতিশক্তি সজীব কোশে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। এই গতিশক্তির বেশির ভাগই তাপশক্তিরূপে বিনষ্ট হয়। সামান্য অংশ ATP উৎপাদনে ব্যবহৃত হয় যা জীবের জৈবনিক ক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেয়। (২) শ্বসনের ফলে জীবদেহের প্রতিটি কোশে অক্সিজেন পৌঁছোয় এবং কোশে উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইড দূরীভূত হয়।
(৩) শ্বসনের মাধ্যমে বিভিন্ন রেচন পদার্থ, যেমন—অ্যামোনিয়া, কিটোনবডি, উদ্বায়ী ফ্যাটি অ্যাসিড, অ্যালকোহল, জলীয় বাষ্প ইত্যাদি দেহ থেকে নির্গত হয়।
(৪) ফুসফুসের মাধ্যমে বিভিন্ন পদার্থ শোষিত হয়, যেমন— CO, NO, অ্যামিনো নাইট্রাইট ইত্যাদি।
(৫) অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্য শ্বসনের মাধ্যমে কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গত হওয়ায় দেহের অম্ল ও ক্ষারের ভারসাম্য বজায় থাকে।
(৬) জলের ভারসাম্য শ্বসনে দেহ থেকে জলীয় বাষ্প নির্গত হয়ে দেহে জলের ভারসাম্য বজায় রাখে।
(৭) তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ নিশ্বাসবায়ুর সঙ্গে বেশ কিছু তাপ দেহ থেকে নির্গত হয়, ফলে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হয়।