প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ভারতের ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হয়। এই যুগে বৈদিক ধর্মের বিরুদ্ধে নানা প্রতিবাদ দেখা দেয় তা প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন নামে পরিচিত এবং নতুন ধর্মের উদ্ভব ঘটে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে তেষট্টিটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। এর মধ্যে জৈন ও বৌদ্ধধর্ম সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। এই আন্দোলনের পেছনে বিভিন্ন কারণ রয়েছে—
ধর্মীয় কারণ : বৈদিক যুগের শেষ দিকে মানুষের মনে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়। ‘শ্রমণ’ ও ‘পরিব্রাজক' নামে দুটি সন্ন্যাসী গোষ্ঠী ছিলেন নতুন চিন্তাধারার অগ্রদূত। তাঁদের প্রভাবে মানুষ কুসংস্কারপূর্ণ ধর্মের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। বৈদিক যুগের শেষ দিকে বৈদিক ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পরিণত হয়। এই ধর্ম যাগযজ্ঞ ও আচারসর্বস্ব হয়ে পড়ায় ধর্মীয় জীবনে প্রচণ্ড অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞপূর্ণ ব্রাহ্মণ্য ধর্মাচরণের পদ্ধতি সাধারণ মানুষের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষের পক্ষে যাগযজ্ঞের বিপুল ব্যয়ভার বহন করা অসম্ভব হয়। যাগযজ্ঞে পশুবলি মানুষের মনে বেদনার উদ্রেক করে। ক্রমে মানুষ বুঝতে পারে, যাগযজ্ঞ কর্মফল ও জন্মান্তর থেকে মানুষকে কখনোই মুক্ত করতে পারে না। তাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতি মানুষের আস্থা হ্রাস পায়। মানুষ সহজবোধ্য ও অনাড়ম্বর ধর্মের জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। নারীরাও বেদ পাঠের অধিকার ধর্মাচরণের অধিকার হ্রাস ব্রাহ্মণ্য ধর্মে বৈশ্য ও শূদ্র শ্রেণির ধর্মাচরণের অধিকার বিশেষভাবে হারিয়ে ক্ষুদ্ধ হয়।
অর্থনৈতিক কারণ : খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ব্রাহ্মণ্য সমাজে এক আত্মনির্ভরশীল কৃষকশ্রেণির উদ্ভব হয়। এর মূলে ছিল লৌহনির্মিত কৃষিসরঞ্জামের ব্যবহার ও গোসম্পদ। লোহার তৈরি লাঙল ও মই ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে কৃষি উৎপাদন অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বৈদিক যাগযজ্ঞে প্রচুর পরিমাণ গোবলি শুরু হলে নতুন কৃষি অর্থনীতি সমস্যার সম্মুখীন হয়। এই সময় গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীর ‘জীবে দয়া' এবং 'অহিংসা-এর বাণী প্রচার করলে কৃষকশ্রেণি তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং ক্ষতিকারক ধর্ম ব্যবস্থার পরিবর্তনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। এই সময় নদী-তীরবর্তী অঞ্চলে বহু নতুন নগর প্রতিষ্ঠিত হয়। ফলে ব্যাবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্য বৃদ্ধির ফলে বৈশ্যশ্রেণির আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটে এবং তারা সামাজিক মর্যাদালাভের জন্য ব্রাহ্মণ্যবাদের অবসান কামনা করে।
সামাজিক কারণ : বৈদিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত ছিল সামাজিক অসাম্যের ওপর, আর এই অসাম্যের মূলে ছিল বর্ণভেদ প্রথা। বর্ণবিভক্ত বৈদিক সমাজে ব্রাহ্মণের স্থান ছিল সবার ওপরে সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা বহু সুযোগসুবিধার একচেটিয়া অধিকারী ছিল। সমাজের অন্যান্য শ্রেণির মধ্যে ব্রাহ্মণদের এই একচেটিয়া আধিপত্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছিল।
যুদ্ধে অংশগ্রহণ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষা ও প্রশাসন পরিচালনার মতো গুরুদায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও সমাজ ও রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণদের তুলনায় ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা ও অধিকার ছিল কম— এই পরিস্থিতি রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী ক্ষত্রিয়দের কাছে ক্রমেই অসহনীয় হয়ে দাঁড়ায় এবং এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনে যে আন্দোলনের স্রষ্টাদের মধ্যে বিখ্যাত দুই পুরুষ মহাবীর ও গৌতম বুদ্ধ ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশজাত।
সম্পদ সৃষ্টি ও রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক দায়দায়িত্ব পালন করা সত্ত্বেও বৈদিক সমাজ ও রাষ্ট্র বৈশ্য ও শূদ্রদের কোনোরকম মর্যাদা দেয়নি। এই শ্রেণিবৈষম্য বর্ণিত বর্ণ দুটির মধ্যে প্রবল ক্ষোভের সম্ভার করেছিল। বৌদ্ধ ও জৈন—এই দুই প্রতিবাদী ধর্মের বর্ণভেদহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বৈশ্য ও শূদ্রদের শুধু তাদের দিকে আকৃষ্টই করেনি, ধর্ম দুটির প্রবল সমর্থকেও পরিণত করেছিল। ব্রাহ্মণ্য সমাজে নারীজাতিকে সম্মানের চোখে দেখা হত না। নারীদের বেদপাঠের এবং পারিবারিক সম্পত্তির অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়। ব্রাহ্মণ্য সমাজে সমাজচ্যুতা রমণীরা ছিল অবজ্ঞা ও অবহেলার পাত্রী। বুদ্ধ ও মহাবীর নারীজাতি, এমনকি সমাজচ্যুতা রমণীদেরও মর্যাদা দেওয়ায় তারা নতুন ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়।
রাজনৈতিক কারণ : খ্রিস্টপূর্বে ষষ্ঠ শতাব্দীতে ভারতীয় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু গণরাজ্যের প্রতিষ্ঠা, সেই গণরাজ্যগুলিতে মতপ্রকাশের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগ এবং উপজাতীয় রীতিনীতির অনুসরণে সেই গণরাজ্যগুলিতে বর্ণাশ্রমবিহীন সমাজের প্রতিষ্ঠা প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলনের রাজনৈতিক পটভূমি তৈরি করেছিল। উল্লেখ্য, সেই সময়ে হিমালয়ের পাদদেশে ও উত্তর পশ্চিম পাঞ্জাবে এরূপ গণরাজ্যগুলি গড়ে উঠেছিল। ড. রোমিলা থাপারের মতে, সম্ভবত বৈদিক গোঁড়ামির প্রতিক্রিয়ারূপে গণরাজ্যগুলির উদ্ভব হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের রক্ষণশীলতার পরিবর্তে নবগঠিত গণরাজ্যগুলিতে উপজাতীয় রীতিনীতি অনুযায়ী বর্ণাশ্রমবিহীন নতুন সমাজ স্থাপিত হয়। সেখানে ব্রাহ্মণদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বা বৈদিক রীতি মান্য করা বাধ্যতামূলক ছিল না। গণরাজ্যগুলিতে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীন মতপ্রকাশের অবাধ সুযোগ | ছিল। এই উদার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মহাবীর বা গৌতম বুদ্ধ তাঁদের দর্শন গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তাঁরাই ব্রাহ্মণ্যবাদের অসাম্য ও অবিচারের বিরুদ্ধে সমাজসংস্কারের ডাক দিয়েছিলেন।