বাংলা ভাষার উপভাষা

 বাংলা ভাষার উপভাষা



ভাষা : এক কথায় যদি ভাষার সংজ্ঞার্থ দিতে হয় তাহলে বলা যেতে পারে– ভাষা ভাবপ্রকাশের জন্যে বাগন্ত্রের সাহায্যে উচ্চারিত ধ্বনির দ্বারা নিষ্পন্ন এমন শব্দসমষ্টি যা স্বতন্ত্রভাবে বিশেষ কোনো জনসমাজে বা জনগোষ্ঠীতে ব্যবহৃত। এইসব সংজ্ঞার্থ মেনে যে ভাষা বাঙালি জনসমাজে প্রচলিত তা-ই বাংলা ভাষা।

উপভাষা : কোনো একটি ভাষা যদি বৃহত্তর অঞ্চলে বহু সংখ্যক মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত হয়, তাহলে অঞ্চলভেদে সেই ভাষার মধ্যেও কিছু কিছু স্বতন্ত্র আঞ্চলিক উচ্চারণবিধি পরিলক্ষিত হয় সেই আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একই ভাষার অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন ভাষার রীতিকে বলা হয় উপভাষা। সুকুমার সেন লিখেছেন— কোনো ভাষা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত ছোট ছোট দল বা অঞ্চলে প্রচলিত বিশেষ ভাষা ছাঁদকে উপভাষা বলে।
বাংলা ভাষায় কথা বলা হয় এমন অঞ্চলটি সুবিস্তীর্ণ। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষা কিছুটা পরিবর্তিত হয়ে যাবেই। এ বাংলায় যেমন মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া ইত্যাদি জেলার তেমনই ও বাংলায় ঢাকা, মৈমনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা ইত্যাদি অঞ্চলের ভাষা মূলত বাংলা ভাষা হয়েও আঞ্চলিক ভাষা। এই আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে ব্যাপকভাবে কাজ করেছিলেন গ্রিয়ারসন সাহেব। তিনি ধ্বনিপরিবর্তনের ধারাগুলি ধরতে চেয়েছিলেন। ভাষাতাত্ত্বিক বা বৈয়াকরণিক বিশ্লেষণ অনেকটাই যেমন ধরা যায়, তেমনি অনেকটা ধরা যায়ও না। এক-এক অঞ্চলের ভাষার বিশেষ বিশেষ যে সুর তাতেই যেন ভাষার আঞ্চলিক মাধুর্য। সে ভাষার স্বরলিপি কোনো লিপিতে বাঁধা পড়ার জন্য নয়, সে স্বরলিপি ওই বিশেষ বিশেষ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে।

বাংলা ভাষার উপভাষা শ্রেণীবিভাগ : চট্টগ্রাম থেকে পুরুলিয়া, মেদিনীপুর থেকে দার্জিলিং পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাংলা ভাষা ব্যবহৃত হয়, ফলে বাংলা ভাষার উপভাষার সংখ্যাও বেশি। বাংলা ভাষার মোট পাঁচটি উপভাষা রয়েছে। যেমন – রাঢ়ী, বঙ্গালী, বরেন্দ্রী, ঝাড়খন্ডী, কামরূপী (রাজবংশী)।

উপভাষার অঞ্চলগত পরিচয় : রাঢ়ী উপভাষা ব্যবহৃত হয় পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা, হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ ও বর্ধমান জেলায়।
বাঙালি উপভাষার প্রচলন রয়েছে পূর্ববঙ্গে। অর্থাৎ ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা, যশোহর, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে।
বরেন্দ্রী উপভাষার প্রচলন রয়েছে উত্তরবঙ্গের অর্থাৎ মালদা, দক্ষিণ দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা প্রভৃতি জেলায়।
ঝাড়খন্ডী উপভাষা ব্যবহৃত হয় দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত বঙ্গে ও বিহারে কিছু অংশে অর্থাৎ মানভূম, সিংভূম, ধলভূম, দক্ষিণ-পশ্চিম বাঁকুড়া, দক্ষিণ পশ্চিম মেদিনীপুর অঞ্চলে।
কামরূপী ভাবে রাজবংশী উপভাষা প্রচলিত আছে উত্তর-পূর্ববঙ্গে অর্থাৎ কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, রংপুর, ত্রিপুরা, উত্তর দিনাজপুর, কাছার অঞ্চলে।

ভাষা ও উপভাষার পারস্পরিক সম্পর্ক

(ক) ভাষা একটি বৃহৎ অঞ্চলে প্রচলিত হয়ে থাকে; উপভাষা অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র অঞ্চলে প্রচলিত হয়।
(খ) ভাষার একটি সর্বজনীন আদর্শ রূপ থাকে; উপভাষা সেই আদর্শ ভাষার আঞ্চলিক রূপ।
(গ) ভাষায় কালজয়ী সাহিত্যকীর্তি রচিত হয়; উপভাষায় সাধারণত লোকগীতি বা লোকসাহিত্যই রচিত হয়, উচ্চাঙ্গের সাহিত্য বিশেষ রচিত হয় না।
(ঘ) ভাষার নির্দিষ্ট ব্যাকরণ থাকে; উপভাষায় সাধারণত কোনো ব্যাকরণ লিখিত হয় না।
(ঙ) একটি আদর্শ ভাষার এলাকার মধ্যে লিখিত রূপটি এক হলেও একাধিক উপভাষা প্রচলিত থাকে; তাই জনগণের মুখের ভাষা অঞ্চলভেদে বিভিন্ন হয়।
(চ) ধ্বনি, রূপ এবং বাগ্‌ধারার ব্যবহারে ভাষার সঙ্গে উপভাষার বিশেষ ধরনের পার্থক্য দেখা যায়।
(ছ) একই ভাষা থেকে বিভিন্ন কারণে একাধিক উপভাষার সৃষ্টি হয়; উপভাষায় মননশীল সাহিত্য-ব্যাকরণ-চর্চার কারণে উপভাষা স্বতন্ত্র ভাষার মর্যাদা পায়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন