ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ
মানুষের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হল ধ্বনি। ধ্বনি ভাষার বহিরঙ্গ গঠন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়। এই সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। যেকোনো জীবন্ত ভাষা মাত্রেই পরিবর্তনশীল। ভাষার বহিরঙ্গ গঠনের পরিবর্তন হলো ধ্বনির পরিবর্তন। এই ধ্বনি পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ রয়েছে-
১. ভৌগোলিক অবস্থানগত পরিবর্তন: একটি জাতির সভ্যতা সংস্কৃতির প্রকৃতি সেই জাতির ভৌগোলিক পরিবেশ ও তার স্থানের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেখানকার ভূপ্রকৃতি রুক্ষ কঠোর সেখানকার ভাষাও কঠোর ও কর্কশ।। কারণ একটি ভাষা একটি জাতির সভ্যতা , সংস্কৃতি , জলবায়ু , ভৌগোলিক অবস্থান পরিবেশ প্রভৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় । আমাদের সুজলা - সুফলা কোমল প্রকৃতির বঙ্গ জননীর মুখের ভাষা বাংলা স্বভাবতঃই কোমল ও সুমধুর । রুক্ষ প্রাকৃতিক পরিবেশের ভাষায় তুলনামূলক ভাবে মিষ্টতা কম , রুক্ষতা তথা কর্কশতা বেশী । এই কারণে জার্মান ও ইংরেজি ভাষা কর্কশ এবং ফরাসী ও ইতালি ভাষা মধুর।
২. ভিন্ন জাতির ভাষার প্রভাব: কোথাও জাতি দীর্ঘকাল অন্য । শাসনাধীনে থাকলে শাসক - জাতির ভাষার প্রভাব শাসিত - জাতির ভাষায় পড়তে থাকে । এর ফলে এক ভাষার শব্দ ও বাগধারাই শুধু অন্য ভাষায় গৃহীত হয় তা নয় , এক - ভাষার উচ্চারণরীতি এবং ধ্বনিও অন্য ভাষায় গৃহীত হয় , এবং এতে গ্রহণকারী ভাষার ধ্বনিপরিবর্তনও সংঘটিত হয় । পশ্চিম বাংলার আদর্শ চলিত বাংলায় তিনপ্রকার শিস ধ্বনির (শ্,ষ্,স্) মধ্যে স্বনিম বা মূল ধ্বনি হিসাবে তালব্য শ ' ই স্বীকৃত । কিন্তু পূর্ববাংলায় ( বাংলা দেশ ) মধ্যযুগ থেকে মুসলমান । শাসনের ব্যাপক প্রভাবের ফলে ফারসি ভাষার প্রভাবে দন্ত্য স ’ - এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায় এবং আধুনিক ভাষাতত্ত্ববিদেরা সেখানকার বাংলায় দন্ত্য ' স ’ কেও মূলধ্বনিরূপে স্বীকার করেন । বাংলায় পদান্তে যুক্ত ব্যঞ্জন স্বরধ্বনি ছাড়া । উচ্চারিত হয় না । অন্য স্বরধ্বনি না থাকলে অন্তত ‘ অ ’ বা ‘ ও ' উচ্চারিত হয় । যেমন — “ নন্দ ’ - এর খাঁটি বাংলা উচ্চারণ হল নন্দো ] , তেমনি বন্ধ = বন্ধো ] । কিন্তু আধুনিক কালে হিন্দির প্রভাবে পদান্তিক যুক্ত ব্যঞ্জনও কোথাও কোথাও স্বরহীনভাবে অর্থাৎ হসন্ত ব্যঞ্জনের মতাে উচ্চারিত হচ্ছে । যেমন — স্ট্রাইক বা ধর্মঘট অর্থে ' বন্ধ ' ।
৩. বাগযন্ত্র ত্রুটি বা আরামপ্রিয়তা: ভাষা ব্যবহারের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হল- বক্তা ও শ্রোতা। বক্তার উচ্চারণের ত্রুটি ঘটলে ধ্বনি বিকৃতি ঘটে। বক্তার ধ্বনি উচ্চারণের সময় বাগযন্ত্রের ত্রুটি থাকলে অনেক ধনী উচ্চারণ করতে পারে না ফলে মূল ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে যায়। যেমন-কাক>কাগ।
বক্তা আরামপ্রিয়তার কারনে শব্দের কঠিন উচ্চারণকে সহজ করতে অনেক সময় যুক্তব্যঞ্জনকে ভেঙে উচ্চারণ করে। আবার কখনো কখনো যুক্ত ব্যঞ্জন এর পূর্বে বা মধ্যে স্বরধ্বনির আগমন ঘটে। যেমন-লক্ষ্মী>লোকটি, ষ্টেশন>ইষ্টেশন,ধর্ম>ধরম।
বক্তা অনেক সময় দ্রুত উচ্চারণ করতে গিয়ে কোন কোন ধ্বনি বাদ দিয়ে দেয় বা ধ্বনির পরিবর্তন করে ফেলে। যেমন-এক কাপ চা>এক চাপ কা।
৪. শ্রবণের ও বোধের ত্রুটি: স্রোতার দিক থেকে শোনার ও বোঝার ত্রুটির ফলে ধ্বনি বিকৃতি ঘটতে পারে। বিদেশী ভাষা থেকে আগত শব্দের ধ্বনিবিকৃতি ও ধ্বনি পরিবর্তন এই কারণে। জার্মান ভাষায় 'Zar' শব্দের উচ্চারণ যদি জার্মান বক্তার উচ্চারণ থেকে ঠিক ঠিক বুঝে নেওয়া যায় না, তবে অনেকে তা উচ্চারণ করে 'জার’ বলে। কিন্তু আসলে 'Zar' এর সঠিক জার্মান উচ্চারণ হলো ‘ৎসার'।
৫. সন্নিহিত ধ্বনির প্রভাবজনিত কারন: উপরের উল্লিখিত ধ্বনি পরিবর্তনের কারণগুলি হল বাহ্যিক কারণ। এছাড়াও ভাষার অভ্যন্তরীণ কারণেও ধ্বনি পরিবর্তন হয়। যেমন- একই ভাষার নিজস্ব একটি ধ্বনির প্রভাবে অন্য ধ্বনির পরিবর্তন হয়, যেমন-পদ্ম>পদ্দ। এখানে ‘দ' ধ্বনির প্রভাবে ‘ম’ ধ্বনি পরিবর্তিত হয়ে 'দ' ধ্বনি হয়েছে। একটি শব্দের সাদৃশ্যে অন্য শব্দের ধ্বনি পরিবর্তন হয়। যেমন- 'হাঁস' ও 'পাতাল' এই দুটি বাংলা শব্দের সঙ্গে সাদৃশ্য থাকায় ইংরেজি শব্দ 'hospital' বাংলায় হয়েছে ‘হাসপাতাল'। আবার ভাষায় নতুন নতুন ধ্বনি সৃষ্টি হতে পারে এবং তার দ্বারা ধ্বনি পরিবর্তন সাধিত হয়। যেমন-বাংলা উচ্চারিত অ্যা,ড়,ঢ় ইত্যাদি ধ্বনিগুলি প্রাচীন বৈদিক সংস্কৃত ভাষা থেকে আসেনি। এগুলির মূলধনী যথাক্রমে এ,ড,ঢ এর উপধ্বনি হিসেবে ব্যবহৃত হতে হতে ক্রমশ স্বতন্ত্র ধ্বনি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। যেমন-এক্ষণ>এখন>অ্যাখন।