শব্দার্থতত্ত্ব || শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ

 

শব্দার্থতত্ত্ব

শব্দার্থতত্ত্ব: ভাষা বিজ্ঞানের যে শাখায় শব্দের অন্তর্গত পরিবর্তনের কারণ ও সূত্র সম্পর্কিত রহস্যকে উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়, তাকে বলা হয় শব্দতত্ত্ব বা শব্দার্থ বিজ্ঞান।

শব্দার্থ পরিবর্তনের কারণ: পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই শব্দের অর্থ চিরকাল অপরিবর্তিত থাকে না। সামাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে। জীবন্ত ভাষার ধর্মই হলো ধ্বনিগত ও অর্থগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মুখের দিকে অগ্রসর হয়ে চলা। নানা কারণে শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে। ভাষাবিজ্ঞানীরা শব্দের অর্থের কারণ গুলিকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছেন। তারমধ্যে প্রধান কয়েকটি কারণ হলো—ভৌগোলিক বা জলবায়ুগত কারণ, ঐতিহাসিক কারণ, উপাদানগত বা উপকরণগত কারণ, ধ্বনিগত বা অর্থগত সাদৃশ্য জনিত কারণ, সামাজিক সংস্কার ও মানসিক বিশ্বাস জনিত কারণ, শিথিলতা বা আরামপ্রিয়তা জনিত কারণ, আলংকারিক প্রয়োগ জনিত কারণ ।

(ক) জলবায়ুগত কারণ: ভৌগোলিক পরিবেশের প্রভাব এবং জলবায়ুগত পার্থক্যের ফলে শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটে।
যেমন-বাংলাদেশের স্নিগ্ধ পরিমণ্ডলে 'অভিমান' শব্দটির অর্থ 'স্নেহ মিশ্রিত অনুযোগ'। কিন্তু পশ্চিম ভারতে শুষ্ক ও কঠিন পরিমণ্ডলে 'অভিমান' শব্দটির অর্থ 'অহংকার'।

(খ) ঐতিহাসিক কারণ: প্রাচীন আর্যরা ছিল যাযাবর জাতি। তখন আর্য শব্দের অর্থ ছিল 'গমনশীল'।কিন্তু ভারতবর্ষে প্রবেশ করার পর আজ ওদের জীবন হয়ে উঠল কৃষি নির্ভর। তখন তারা আর যাযাবর রইল না। তথাপি তাদের আর্য নামটি রয়ে যায়। এখন আর্য বলতে বোঝায় ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের নরগোষ্ঠীকে। শব্দের এই পরিবর্তন মূলত ঐতিহাসিক কারণে ঘটেছে।

(গ) উপাদানগত কারণ: প্রাচীনকালে পেপিরাস গাছের মজ্জা দিয়ে তৈরি হতো কাগজ। পেপিরাস থেকে নাম রাখা হয় পেপার। এখন অন্যান্য উপাদান থেকে তৈরি কাগজকেও পেপার বলা হয়। উপাদানের পরিবর্তন ঘটলেও পুরাতন নামটি অপরিবর্তন থেকে যায়। এখন পেপার বলতে লেখার উপাদানকে বোঝায়।

(ঘ) সাদৃশ্য জনিত কারণ: বৈদিক শব্দ 'রোদসী' শব্দের অর্থ ছিল স্বর্গ এবং পৃথিবী দুই জগৎ। ক্রন্দসী শব্দের অর্থ ছিল গর্জনকারী প্রতিদ্বন্দ্বী সৈন্যদয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঊর্বশী কবিতায় রোদসীর সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে ক্রন্দসী শব্দটিকে 'অন্তরীক্ষ' অর্থে ব্যবহার করেছেন। এখানে সাদৃশ্য জনিত কারণে শব্দার্থের পরিবর্তন ঘটেছে।

(ঙ) মানসিক সংস্কার: অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কার বসত গ্রামাঞ্চলে রাত্রিকালে সাপকে বলা হয় লতা বা পোকা। চালের অভাবকে বলা হয় চালবাড়ন্ত। কারও মৃত্যু হলে বলা হয় তিনি স্বর্গলোক করেছে। অথিতি বিদায় নেবার সময় বলা হয়- এস বা আসুন। এসবের কারণ হলো সাধারণ মানুষের ধারণা অশুভ বিষয় বা বিপদজনক বস্তুর নাম উচ্চারণ করলে বিপদ আসতে পারে।

(চ) শৈথিল্য ও আরামপ্রিয়তা: আলস্য বশত আরামপ্রিয় তার কারণে অনেক সময় সম্পূর্ণ বাক্য উচ্চারণ না করে সংক্ষেপে কাজ চালানো হয়, এতে শব্দটির নতুন অর্থ সৃষ্টি হয়। চা ও জলখাবার না বলে সংক্ষেপে বলা হয় চা-টা। সন্ধেবেলায় প্রদীপ জ্বালানোকে বলা হয় 'সন্ধ্যে দেওয়া'।

(ছ) আলংকারিক প্রয়োগ: অলংকার প্রয়োগ করে বহু বস্তুর নামকরণ করা হয়।ক্রমশ অলংকারটি গৌণ হয়ে যায় এবং নামটি সাধারণ বিশেষ্য পথ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেমন-চোখের তারার মত দেখতে একটি ফুলের নাম 'নয়ন তারা'। লাউয়ের ডগার মত দেখতে একটি সাপের নাম 'লাউডগা'। মাছ শিকার করে এমন একটি রঙিন পাখির নাম 'মাছরাঙা'। এগুলি হল আলংকারিক প্রয়োগ। এগুলি দীর্ঘকাল ব্যবহার করার ফলে অলংকার গুলি গৌণ হয়ে গেছে এবং শব্দগুলি সাধারণ অর্থে প্রচলিত হয়ে পড়েছে।


শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা📌📌 Click

নবীনতর পূর্বতন