বাংলা শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা

 

শব্দার্থতত্ত্ব

শব্দার্থতত্ত্ব: ভাষা বিজ্ঞানের যে শাখায় শব্দের অর্থ পরিবর্তনের কারণ সূত্র সম্পর্কিত রহস্য উন্মোচন করার চেষ্টা করা হয়, তাকে বলা হয় শব্দতত্ত্ব বা শব্দার্থ বিজ্ঞান।

ভাষা প্রবাহিত নদীরই মতো। নদী যেমন তার গতিপথ প্রায়ই পরিবর্তন করে, ভাষারও তেমনই রূপের পরিবর্তন ঘটে, অর্থেরও পরিবর্তন ঘটে। কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার মতো জীবন্ত ভাষায় শব্দার্থের এরূপ পরিবর্তন খুবই স্বাভাবিক। ফলে এই ভাষার বেশকিছু শব্দ তাহাদের মূল অর্থটিকে প্রসারিত করে, কখনও সংকুচিত করে, কখনও মূল অর্থটির উন্নতি ঘটে, আবার অবনতি ঘটে, এমনকি সম্পূর্ণ নূতন অর্থে প্রযুক্ত হয়।


শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা গুলিকে ভাষাবিজ্ঞানীরা পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছেন— (১) অর্থের বিস্তার (২) অর্থসংকোচ (৩) অর্থসংক্রম (৪) অর্থের উন্নতি (৫) অর্থের অবনতি।

অর্থ বিস্তার বা সম্প্রসারণ: কোন শব্দ যখন কোন ব্যক্তি বা বস্তুর বিশেষ ধর্ম বা গুণকে অতিক্রম করে, বহু বস্তুর সাধারণ ধর্ম ও গুণের পরিচায়ক হয়ে ওঠে, তখন শব্দের অর্থের বিস্তার ঘটে।

যেমন— 'ধন্য' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'ধনশালী ব্যক্তি'। কিন্তু এখন অর্থ বিস্তারের ফলে 'ধন্য' বলতে 'সার্বিক সৌভাগ্যবান ব্যক্তিকে' বোঝায়। 'বর্ষ' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'বর্ষাকাল', এখন সম্প্রসারিত অর্থ হয়েছে 'বৎসর বা সারা বছর'। 'তৈল' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'তেলের নির্যাস', এখন সম্প্রসারিত হয়েছে বিভিন্ন দানাশস্য থেকে উৎপন্ন তরল নারিকেল থেকে উৎপন্ন তরল এবং খনিজ কিছু কিছু তরলকে বলা হয়। 'বেনারসি' শব্দের অর্থ ছিল বেনারসে উৎপন্ন যেকোনো জিনিস, বিশেষভাবে শাড়ি। এখন অর্থ হয়েছে বেনারস ছাড়া অন্যত্র উৎপন্ন অনুরূপ শাড়ি।


অর্থসংকোচ: শব্দের অর্থ যখন ব্যাপকতা হারিয়ে বিশেষ সংকীর্ণ অর্থে প্রযুক্ত হয় তখন সেখানে শব্দার্থের সংকোচ  হয়।
যেমন—'মৃগ' শব্দের আদি অর্থ ছিল যে কোন পশু। এখন সংকুচিত অর্থ হয়েছে 'হরিণ'। 'পঙ্কজ' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'পঙ্কে জাত বস্তু'। এখন সংকুচিত হয়েছে 'পদ্মফুল'। 'অন্ন' শব্দের অর্থ ছিল 'খাদ্য'। এখন সংকোচিত অর্থ হলো 'ভাত'। 'সন্তান' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'সম্যক বিস্তার'। এখন সংকুচিত হয়েছে 'পুত্র বা কন্যা'।


অর্থ সংশ্লেষ: অনেক সময় শব্দার্থের বারংবার প্রসারণ এবং সংকোচনের ফলে আদি বা মধ্যবর্তী অর্থ বিলুপ্ত হয়ে যায়। তখন নতুন অর্থের আগমন ঘটে। একে বলা হয় অর্থসংক্রম বা অর্থসংশ্লেষ।

যেমন— 'পাষণ্ড' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'ধর্ম সম্প্রদায়', পরবর্তী অর্থ হয়েছে 'বিরুদ্ধ সম্প্রদায়' এখনো অর্থ হয়েছে 'নিষ্ঠুর অত্যাচারি'। 'রাজপুত' শব্দের অর্থ ছিল রাজার 'পুত্র' পরবর্তী অর্থ হয়েছে 'জাতি বিশেষ'। 'মন্বন্তর' শব্দের অর্থ ছিল এক মনুর কাল শেষ এবং অন্য মনুর শাসনকালের আরম্ভ। এখন অর্থ হয়েছে 'দুর্ভিক্ষ'।


অর্থের উন্নতি: কোন শব্দ যখন তার মূল অর্থ পরিত্যাগ করে উন্নত অর্থ গ্রহণ করে তখন শব্দার্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি ঘটে।

যেমন—'মন্দির' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'গৃহ বা ঘর' এখন উন্নত হয়েছে 'দেবালয়'। 'বাসর' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'বাসগৃহ'। এখন উন্নত অর্থ হয়েছে বর-বধূ প্রথম যে ঘরে রাত্রি বাস করে। 'বিধি' শব্দের অর্থ ছিল- নিয়ম বা বিধি নিষেধ। এখন উন্নত হয়েছে- ঈশ্বর বা বিধিলিপি।


অর্থের অবনতি: কোন শব্দ যখন তার মূল অর্থ পরিত্যাগ করে অপেক্ষাকৃত হীন অর্থ গ্রহণ করে তখন অর্থের অপকর্ষ বা অবনতি ঘটে।

যেমন—'মহাজন' শব্দের আদি অর্থ ছিল 'মহৎব্যক্তি'। এখন এর অর্থ হয়েছে 'সুদের কারবারি বা ঋন ব্যবসায়ী'। 'ঝি' আদি অর্থ ছিল 'কন্যা'। এখন অপকর্ষ বাচক অর্থ হয়েছে 'পরিচালিতা বা দাসী'। 'রাগ' কথার অর্থ ছিল 'অনুরাগ বা ভালোবাসা'। এখন অপকর্ষবাচক অর্থ হল 'ক্রোধ'।

নবীনতর পূর্বতন