ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর মেদিনীপুরের বীরসিংহ গ্রামে বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেন। বালক বয়স থেকে দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করে বড়ো হন। অধ্যাপকরা ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে 'বিদ্যাসাগর' উপাধি প্রদান করেছিলেন। ওই বছরই তিনি ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে যোগদান করেন। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজের সহকারী অধ্যক্ষ এবং ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ওই কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হয়েছিলেন। এছাড়া তিনি বাংলা শিক্ষা প্রসারে এবং বহুবিধ সমাজ কল্যাণমূলক কাজের সচেষ্ট ছিলেন।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের রচনাপঞ্জী ও প্রকাশকাল
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রথম রচনা অনুমান করা হয় ‘বাসুদেব চরিত’ ১৮৪৭ এর আগে।
অনুবাদ মূলক রচনা:-
‘বেতাল পঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭)- ‘হিন্দি বৈতাল পচ্চীসী’ থেকে অনুবাদ ।
‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ ২য় ভাগ (১৮৪৮)- মার্শম্যানের হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল এর কয়েকটি অধ্যায়ের অনুবাদ।
‘জীবনচরিত’ (১৮৪৯)- চেম্বার্সের Examplary biographies অবলম্বনে রচিত।
‘বোধোদয়’ (১৮৫১) শিশু শিক্ষা চতুর্থ ভাগ - চেম্বার্সের Rudiments of knowledge অবলম্বনে রচিত।
‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪)-কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম নাটকের গদ্যানুবাদ।
‘কথামালা’ (১৮৫৬)- ঈশপের ফেবলস অবলম্বনে রচনা করেন।
‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০)- ভবভুতীর উত্তরচরিত এবং বাল্মিকী রামায়ণের উত্তর কান্ডের আখ্যানের অনুসরণ।
‘মহাভারত-উপক্রমণিকা ভাগ ' (১৮৬০)-মহাভারতের আংশিক অনুবাদ যা তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় মহাভারত আদিপর্ব নামে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬৯)- শেক্সপিয়ারের ‘কমেডি অফ ইরর’ এর গদ্যানুবাদ।
মৌলিক গ্রন্থ:-
‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৪)-বাঙালির লেখা সংস্কৃত সাহিত্যের প্রথম ইতিহাস।
‘বিধবাবিবাহ চলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (প্রথম খন্ড ও দ্বিতীয় খন্ড-১৮৫৫)
‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (প্রথম খন্ড-১৮৭১ ও দ্বিতীয় খন্ড-১৮৭৩)
‘বিদ্যাসাগরচরিত’(১৮৯১) ও ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’(১৮৬৩) -তাঁর স্বরচিত জীবনচরিত বিশুদ্ধ সাহিত্যকর্ম হিসেবে অতীব সুখপাঠ্য হয়েছে।‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ তার বন্ধুর বালিকা কন্যা প্রভাবতী শোচনীয় মৃত্যুশোকের বলে রচিত।
‘পদ্যসংগ্রহ’(প্রথম ভাগ-১৮৮৮ ও দ্বিতীয় ভাগ-১৮৯০)
‘নিষ্কৃতিলাভ প্রয়াস’ ১৮৮৮
‘সংস্কৃত রচনা’ ১৮৮৯
‘শ্লোকমঞ্জরী’ ১৮৯০
‘ভূগোল খগোল বর্ণনম্’ ১৮৯২
‘বিধবাবিবাহ ও যশোহর হিন্দুধর্মরক্ষিণী সভা’ ১৮৮৪ (ছদ্মনামে প্রকাশিত)
ব্যঙ্গাত্মক রচনা:
‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘ব্রজবিলাস’ (১৮৮৪)-এই তিনটি পুস্তক ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল।
‘রত্নপরীক্ষা’ ১৮৮৬ (কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য ছদ্মনামে প্রকাশিত)
পাঠ্যপুস্তক জাতীয় রচনা:
‘ঋজু পাঠ’ (প্রথম ভাগ-১৮৫১ ,দ্বিতীয় ভাগ ও তৃতীয় ভাগ -১৮৫২)
‘ব্যাকরণ কৌমুদী’ –(প্রথম ভাগ-১৮৫৩ দ্বিতীয় ভাগ-১৮৫৩ তৃতীয় ভাগ-১৮৫৪ চতুর্থ ভাগ-১৮৬২)
‘বর্ণপরিচয়’ (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ-১৮৫৫)
‘চরিতাবলী’ ১৮৫৬
‘আখ্যানমঞ্জুরী’ ১৮৬৩
‘শব্দমঞ্জরী’ ১৮৬৪
বাংলা গদ্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
বাংলা গদ্যের গঠনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান ছিল অপরিসীম। তাঁর বহু পূর্বে বাংলা গদ্যের সূচনা হয়েছিল সুতরাং তাদের প্রকৃত জনক বলা চলে না।কিন্তু তিনি প্রথম বাংলা গদ্যকে শিল্পের সৌন্দর্য ও লাবণ্য দান করেছেন। একই সঙ্গে ক্লাসিকাল এবং লঘু রীতিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ভাষা যে শুধুমাত্র ভাব প্রকাশের মাধ্যম নয়, তা যে শিল্প সৃষ্টিরও উপাদান সে কথা বিদ্যাসাগরই প্রথম প্রমাণ করেন। শিক্ষা বিস্তার, বিধবা বিবাহ প্রচলন, বহু বিবাহ প্রতিরোধ ইত্যাদি সামাজিক সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে তিনি বাংলা গদ্যকে বেছে নিয়েছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুবাদ মূলক রচনাগুলির ভাষা মৌলিক রচনা মতোই আস্বাদন যোগ্য। তিনি প্রধানত সংস্কৃত, হিন্দি ও ইংরেজি থেকে বহু গ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করেছেন। শেক্সপিয়ারের কমেডি অফ ইরর এর অনুবাদের (ভ্রান্তিবিলাস) সময় তিনি বিদেশি স্থান ও চরিত্রের নাম উল্লেখ না করে বঙ্গদেশীয় নাম ব্যবহার করেছেন। বাংলা ভাষায় যে বিজ্ঞান চর্চা করা সম্ভব তার প্রথম আবার পাওয়া গেছে 'জীবন চরিত' গ্রন্থে। এখানে বিভিন্ন বিজ্ঞানি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সহজ-সরল বিবৃতি রয়েছে। এইসব গুরুগম্ভীর রচনার পাশাপাশি বিদ্যাসাগরের লঘু ভাষারীতির দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় তাঁর ব্যঙ্গাত্মক রচনাগুলিতে। তিনি বাংলা গদ্যে সঠিকভাবে বিরাম চিহ্ন প্রয়োগ করেন। অকারণে তিনি বাক্যকে জটিল করেননি। সমাসবদ্ধ শব্দ প্রয়োগ করলেও বাক্য হয়েছে সহজ, সরল ও প্রাঞ্জল। আভিধানিক অর্থে বাহিরেও যে বহু বাংলা শব্দের আরো ব্যঞ্জনাময় অর্থ থাকতে পারে সে কথা তিনি প্রথম প্রমাণ করেছিলেন। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগরের 'বর্ণপরিচয়' -এর মধ্য দিয়ে বাঙালির বাংলা ভাষায় শিক্ষার যাত্রা শুরু হয়েছিল।