মগধের উত্থান ও মগধের উত্থানের কারণ

 মগধের উত্থান ও মগধের উত্থানের কারণ



হর্যঙ্ক বংশ

বিম্বিসার: হর্যঙ্ক বংশের বিম্বিসার সম্ভবত ৫৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন। তাঁর আমল থেকেই মগদের বিস্তার শুরু হয়। তাঁর উপাধি ছিল 'শ্রেণীক'। তিনি অঙ্গরাজ আক্রমণ করেন এবং অঙ্গরাজ ব্রহ্মদত্তকে পরাজিত করে অঙ্গরাজ্যকে মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন।  তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক। রাজ্যবিস্তারে বিম্বিসার দু-প্রকার নীতি অনুসরণ করতেন—বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন ও যুদ্ধ। বিম্বিসার কোশল-রাজকন্যা কোশলদেবীকে বিবাহ করে কাশী লাভ করেন। বৈশালী রাজকন্যা চেন্ননাকে বিবাহ করার ফলে মগধের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া, বিদেহ-রাজকন্যা বাসবী ও মদ্র-রাজকন্যা ক্ষেমাকে বিবাহ করে নিজেকে আরও শক্তিশালী করেন। কেবলমাত্র বিজেতা নয়, শাসকরূপেও বিম্বিসার ছিলেন অত্যন্ত সফল। উপযুক্ত কর্মচারী নিয়োগ, স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থার প্রবর্তন, জমি জরিপ করে কর-নির্ধারণ প্রভৃতি তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ রাখে। বিম্বিসার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন, তবে অন্যান্য ধর্মের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল। আনুমানিক ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি নিজ পুত্র অজাতশত্রুর হাতে নিহত হন।

অজাতশত্রু: অজাতশত্রু (খ্রি. পূ. ৪৯৩-৪৬২ অব্দ) পিতার রাজ্যবিস্তারনীতি অক্ষুণ্ণ রাখেন। বিম্বিসারের হত্যাকাণ্ডে মর্মাহত কোশলদেবী প্রাণত্যাগ করলে তাঁর ভাই কোশলরাজ প্রসেনজিৎ কাশী পুনর্দখল করেন। ফলে অজাতশত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ বাধে। দীর্ঘদিন যুদ্ধ চলার পর প্রসেনজিৎ পরাস্ত হন এবং নিজ কন্যার সঙ্গে অজাতশত্রুর বিয়ে দিয়ে এবং কাশী (বেনারস) যৌতুক হিসেবে প্রদান করে মিত্রতা স্থাপন করেন। অতঃপর অজাতশত্রু বৈশালীর লিচ্ছবীরাজ চেতকের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন।  এই যুদ্ধে বৃজি, মল্লসহ প্রায় ৩৬টি গণরাজ্য অজাতশত্রুর বিরুদ্ধে ও বৈশালীর পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। কিন্তু অজাতশত্রু কুটকৌশলে গণরাজ্যগুলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেন। যুদ্ধের পর গণরাজ্যগুলির পতন ঘটে। এই সময় মগধরাজ গঙ্গা ও শোন নদীর সংগমস্থলে পাটলিগ্রামে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে সেখানেই পাটলিপুত্র নগর গড়ে উঠেছিল।

পরবর্তী শাসকগণ: অজাতশত্রুর পরে মগধের সিংহাসনে বসেন উদয়ী বা উদয়ীভদ্র (৪৫৯ খ্রিস্টপূর্ব)। তাঁর উদ্যোগেই  পাটলিপুত্র মহানগরী নির্মিত হয়েছিল। উদয়িনের পরে যথাক্রমে অনিরুদ্ধ, মুণ্ড ও নাগদশক রাজা সিংহাসনে বসেন।

শিশুনাগ বংশ

হর্যঙ্ক বংশের শেষ শাসক নাগদশককে হত্যা করে তাঁরর সভাসদ শিশুনাগ মগধের সিংহাসনে বসেন এবং শিশুনাগ বংশের রাজত্বের সূচনা হয়। তিনি মগধের রাজধানী রাজগৃহ থেকে বৈশালীতে স্থানান্তরিত করেন। তাঁর আমলে মগধ উত্তর ভারতের শ্রেষ্ঠ রাজ্যে পরিণত হয়। শিশুনাগ এর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র কালাশোক বা কাকবর্ণ সিংহাসন লাভ করেন। তিনি পাটলিপুত্রের রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। তাঁর উদ্যোগে দ্বিতীয় বৌদ্ধসংগীতি আহূত হয়েছিল।

নন্দবংশ

মহাপদ্মনন্দ ছিলেন নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠাতা। পুরান এবং জৈন ও বৌদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থে তাকে সূত্র বলা হয়েছে। তাঁর সময়ে কোশলরাজ্য মগধ সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এ ছাড়া তিনি যেসব ক্ষত্রিয়রাজ্য দখল করেছিলেন, সেগুলি হল— পাঞ্চাল, কাশী, ইক্ষ্বাকু, কলিঙ্গ, অস্মক, কুরু, মিথিলা প্রভৃতি। মহাপদ্মনন্দ ছিলেন উত্তর ভারতের প্রথম সম্রাট।

মহাপদ্মনন্দের পর আরও আটজন নন্দবংশীয় রাজা মগধের সিংহাসনে বসেন। এই বংশের শেষ রাজা ছিলেন ধননন্দ। ধননন্দ ছিলেন বিশাল সাম্রাজ্য ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অধিপতি। অর্থের প্রতি অত্যধিক আসত্তির জন্য তাঁর এইরূপ নামকরণ হয়েছিল। বলে কথিত আছে।  চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নন্দবংশের উচ্ছেদ করে মগধের সিংহাসন দখল করেন।


প্রশ্ন ও উত্তর 📌 📌


মগধের উত্থানের কারণ

(১) বিম্বিসার, অজাতশত্রু, শিশুনাগ এবং মহাপদ্ম নন্দের মতো সমরকুশলী ও উদ্যমী নেতৃবৃন্দ এবং কৌটিল্য ও রাধাগুপ্ত-র মতো ভারতবিখ্যাত কূটনীতি-বিশারদ মন্ত্রীদের ভূমিকাক‌ ছিল মগধের উত্থানের পেছনে।
(২) মগধের ভৌগোলিক অবস্থান অনুকূল। গঙ্গা, শোণ ও চম্পা নদীবেষ্টিত মগধ ছিল অতি সুরক্ষিত। মগধের প্রথম রাজধানী রাজগৃহ পাঁচটি পাহাড় দ্বারা বেষ্টিত হওয়ায় খুবই নিরাপদ ছিল। গঙ্গা, শোণ ও গন্ডক নদীর সংগমস্থলে অবস্থিত পাটলিপুত্র কার্যত দুর্ভেদ্য ছিল। পাটলিপুত্র ছিল একটি জলদুর্গ-বিশেষ এবং সে যুগে এই নগরটিকে অধিকার করা আদৌ সহজসাধ্য ছিল না। চতুর্দিকে নদী থাকায় শত্রুদ্বারা পাটলিপুত্রের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা যেমন ছিল খুবই কম, তেমনি নদীপথ ধরে মগধের সেনাবাহিনী অবাধে চতুর্দিকে চলাফেরা করতে পারত।
(৩) গঙ্গা ও অন্যান্য নদীগুলি মগধকে উর্বরা এবং সুজলা-সুফলা করেছিল। এই নদীর উপর একচ্ছত্র আধিপত্যের ফলে প্রতিবেশী রাজ্যগুলিকে নিয়ন্ত্রণে রাখা মগধের পক্ষে সহজতর হয়েছিল এবং এই নদীর মাধ্যমেই মগধের বৈদেশিক বাণিজ্য চলত।
(৪) খনিজ সম্পদে পূর্ণ মগধের লোহার খনিগুলি ছিল মগধের সামরিক শক্তির প্রধান সহায়।
(৫) স্থল ও জল পথে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে মগদের নিবির সংযোগ থাকায় বাণিজ্য ছিল সমৃদ্ধিশালী।



নবীনতর পূর্বতন