সতীনাথ ভাদুড়ী (১৯০৬-১৯৬৫)
সতীনাথ ভাদুড়ী জন্মগ্রহণ করেন বিহারের পূর্ণিয়ায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর । তাঁর লেখাপড়া ও কর্মজীবন কাটে পূর্ণিয়াতেই। তিনি পেশায় একজন উকিল। তিনি রাজনৈতিক ভাবধারায় প্রভাবিত হয়ে প্রথমে গান্ধীজীর অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে এবং পরবর্তি সময়ে তিনি কংগ্রেসে যোগ দেন ও কারাবরণ করেন। পরে তিনি সোসালিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং কম্যুনিজমের প্রতি গভীর আকর্ষণ অনুভব করেন। সতীনাথ ভাদুড়ী ছিলেন মানবতাবাদী, মানবিক বোধে, মানবতার সাধনাই তাঁর চরম সাধনা। রাজনীতি, মানুষ, সমাজ সতীনাথের রচনায় প্রধান হয়ে আছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হলেন। তিনি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ তিনি মারা যান।
তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হল— 'জাগরী' (১৯৪৫), 'ঢোকাই চরিত্ মানস' (১৯৪৯ ১ম খণ্ড, ১৯৫১ ২য় খণ্ড ), 'চিত্র গুপ্তের ফাইল' (১৯৪১), 'অচিন রাগিনী' (১৯৫৪), 'সংকট' (১৯৫৭), 'দিগভ্রান্ত' (১৯৬৬) ইত্যাদি।
জাগরী : এটি তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস । ভাগলপুরে জেলে বসে সতীনাথ রাজনৈতিক (কারা) উপন্যাস 'জাগরী রচনা করেন। আগস্ট আন্দোলনে পটভূমিকায় উপন্যাসটি রচিত হয়েছে।'শনিবারের চিঠি' পত্রিকায় উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়। প্রথম উপন্যাস হল 'জাগরী' (১৯৪৫)। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই সতীনাথ ঔপন্যাসিক হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। আগস্ট আন্দোলনে বন্দি হয়ে কারাগারে এসেছে একই পরিবারের বাবা, মা, বিলু। বাবা গান্ধিবাদী। মা স্বামীর কাজকর্মের সহযোগী, বিলুর ভাই নীলু কমিউনিস্ট, দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। ফাঁসির সেল'--এ আছে বিলু। তার বাবা আছেন 'আপার ডিভিশন ওয়ার্ড'-এ এবং মা আছেন 'আওরাৎকিতায়'। তার ভাই নিলু আছে 'জেল গেট'-এ। বিলু কংগ্রেস সোস্যালিস্ট দলের সদস্য এবং ফাঁসির আসামী। ছোটো ভাই নিলু কমিউনিস্ট দাদার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। দাদার লাশ নিতে জেল-গেটে অপেক্ষা করছে। তার বাবা গান্ধিবাদী। মা হলেন বাঙালি গৃহবধূ। উপন্যাসে শেষ পর্যন্ত বিলুর ফাঁসি হয়নি।প্রত্যেক চরিত্রের রাজনৈতিক সত্ত্বাকে যথাযথভাবে পরিস্ফুট করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন। প্রত্যেকের আত্মকথনমূলক জবানবন্দি নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি, ঘটনা ও চরিত্রের যাবতীয় ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি হয়েছে। উপন্যাসটি বাংলা সাহিত্যের একটি সার্থক রাজনৈতিক উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৫০ সালে প্রথম রবীন্দ্র পুরষ্কার পায়।
'UNESCO থেকে লীলা রায় উপন্যাসটির ইংরাজি অনুবাদ 'The Vigil' - ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন । নারায়ণ প্রসাদ ভার্মা 'বিহার সাহিত্য ভবন' থেকে '১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ করেন । সোহন সিং মিশা পাঞ্জাবী ভাষায় উপন্যাসটিকে অনুবাদ করেন ।
ঢোঁড়াই চরিতমানস ১ম খণ্ড (১৯৪১), ২য় খণ্ড (১৯৫১): সতীনাথ ভাদুড়ীর 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' শ্রেষ্ঠ উপন্যাস। ঢোঁড়াই বড়ো হয়েছে বিহারের একটি শহর জিরানিয়ার নিকটবর্তী তামাটুলির তামা সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে। তাৎমারা জাতিতে তাঁতি, কিন্তু ঘরের কাজ আর কুয়োর বালি ছাঁকার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তার পাশেই আছে ঠাঙ্গড়টুলি। এসবই ঢোঁড়াই-এর পরিচিত জগত। তাৎমা সম্প্রদায় ঢোঁড়াইকে রামচন্দ্র মনে করে। শিশুবয়সে ঢোঁড়াই মায়ের স্নেহ পায়নি বললেই চলে। বাবা নেই, মা তাকে ভালোবাসে না। ঢোঁড়াই তাৎমাটুলির মানুষদের ছেড়ে ঠাঙ্গরটুলির মানুষদের কাছে চলে আসে। পশ্চিমের মেয়ে রামিয়াকে পছন্দ করে না তাৎমারা। তাতে কিছু এসে যায় না ঢোঁড়াই-এর। সে তো পছন্দ করে। রামিয়াকে বিয়ে করে নিয়ে চলে আসে ঢোঁড়াই। এই বিবাহের মধ্যে দিয়ে ঢোঁড়াই তার নিজের সমাজ অর্থাৎ তাতমা সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। গ্রাম ছেড়ে, গ্রামীণ সমাজকে ছেড়ে ঢোঁড়াই চলে যায়। বিধবা সাগিয়ার সঙ্গে দেখা হয়, প্রেম হয়, তারপর কোথায় মিলিয়ে যায় সাগিয়া। ঢোঁড়াই রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হয়, যোগ দেয় ক্রান্তি দলে। দেশপ্রেমের গান শেখে। 'গান্ধিজির সত্যাগ্রহের বার্তা ছড়ায়। সেই বার্তা ছড়াতে ছড়াতে সে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে হয়ে ওঠে নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গ ঢোঁড়াই শেষকালে আত্মসমর্পণ করে পুলিশের কাছে থানায়। ‘ঢোঁড়াই চরিত মানস' বাংলা সাহিত্যের এক বিস্ময়কর উপন্যাস। তুলসীদাসের রামায়ণের মতো এই উপন্যাসের বিন্যাস। এ উপন্যাসের পরিধি বাংলার অভ্যস্ত মধ্যবিত্ত জীবনের মধ্যে আটকে নেই। এর জগৎ বিহারের অন্ত্যজ ধাঙড় তাৎমাদের নিয়ে।
অচিন রাগিনী (১৯৫৪): ‘অচিন রাগিণী’ উপন্যাসে এক নতুন মানসিক সম্পর্ক, মান-অভিমান, আঘাত আকর্ষণের ছবি এঁকেছেন। পিলে আর তুলসী দুই বন্ধু। নতুন দিদিমার প্রতি পিলে আর তুলসীর প্রেম-ভালোবাসা, মান-অভিমান নিয়ে কাহিনী। পিলেই এই কাহিনির কথক এবং সে-ই বিশ্লেষক। এই উপন্যাসের কাহিনি মূল্য অল্প হলেও পারস্পরিক হৃদয়-সম্পর্কের বিশ্লেষণে ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব যথেষ্ট।
চিত্রগুপ্তের ফাইল (১৯৪৯): 'মাতৃভূমি' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 'চিত্র গুপ্তের ফাইল' একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। বিহারের কাটিহারের জুটমিলের শ্রমিকদের আন্দোলনকে উপন্যাসে যথাযথভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছে। শ্রমিক নেতা অভিমন্যুর জীবন, সংগ্রাম, মৃত্যু, সৎকার দৃশ্য প্রশংসানীয়।
সংকট: 'সংকট' (১৯৫৭) আধুনিক চেতনাপ্রবাহী উপন্যাস। লেখক উপন্যাসের চরিত্রদের প্রতিই অধিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। বিশ্বাসজীর চরিত্রকে যথাযথভাবে পরিস্ফুট করেছেন সতীনাথ। বিশ্বাসজীর সখ, রাজনীতি জনসেবা কোনো কিছু বাদ দেননি লেখক। মুনিয়ার ব্যর্থ দাম্পত্য জীবনও আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে—এই সব দিক থেকে উপন্যাসটির গুরুত্ব যথেষ্ট। লেখক মানুষের আত্মানুসন্ধানের কাহিনীকে রূপদান করেছেন সংকট উপন্যাসে।
দিগভ্রান্ত: 'দিগ্ভ্রান্ত' (১৯৬৬) সতীনাথ ভাদুড়ীর শেষ উপন্যাস। আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতাবোধ ও নিঃসঙ্গতার কাহিনী এই উপন্যাসের বিষয়। এই উপন্যাসে সুবোধ ডাক্তার, অতসীবালা, সুশীল মনি একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েও কীভাবে আবার তারা নিজেদেরকে নিজেরা ফিরে পেল, তার কাহিনি বিবৃত হয়েছে।
সতীনাথ ভাদুড়ীর উপন্যাসে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও চেতনা প্রবাহ রীতির যে সার্থক প্রয়োগ এই উপন্যাসে লক্ষ করা যায় তা বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা উপন্যাসে বিরল। সমস্ত চরিত্রগুলিই আত্মবিশ্লেষণে পাঠকের কাছে প্রত্যক্ষ, জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক উপন্যাস গুলির মধ্য 'জাগরী' অন্যতম। উপন্যাসের চরিত্রগুলির আদর্শ, নিষ্ঠা, ত্যাগ স্বীকার, উচ্ছ্বাস, ভাবপ্রবণতা, ব্যক্তিগত আনন্দ-বেদনা, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
ছোটগল্প: ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৬৪ সালের মধ্যে তাঁর সাতটি গল্পের বই বেরিয়েছে। তিনি ৬০-৭০টি গল্প লিখেছিলেন। গল্পসংকলন—‘গণনায়ক' (১৯৪৮), 'অপরিচিতা' (১৯৫৪), 'চকাচকী' (১৯৫৬), 'পত্রলেখার বাবা' (১৯৫১), 'জমি' (১৯৬২), 'আলোকদৃষ্টি' (১৯৬৪)।
উপন্যাসের মতো ছোটোগল্পের বিষয় বৈচিত্র্যে, গঠন নৈপুণ্যে, ঘটনা বিন্যাসে, কাহিনি সংস্থাপন ও ভাষা ব্যবহারে গল্পগুলি চমৎকারিত্বের সৃষ্টি করে।