মঙ্গলকাব্য রচনার সামাজিক কারণ
খ্রিস্টীয় দ্বাদশ থেকে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যকালে সেন রাজত্ব কালে বাংলায় মুসলমান আক্রমণ শুরু হয়। তখন রাজশক্তি ছিল দুর্বল এবং জনসমর্থন বঞ্চিত। ফলে আক্রমণকারী মুসলমানেরা সহজেই জয়ী হয়। প্রথম দিকে মুসলমানগণ এসেছিল লুণ্ঠনের জন্য। ফলে বাংলায় দীর্ঘকাল চলেছিল অরাজকতা।
সেকালে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের পরিবর্তিত রূপের প্রাধান্য ছিল। তার প্রমাণ চর্যাগীতি। বাংলা দেশ ছিল অনার্যদের দেশ। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মিলনে বাংলার উদ্ভব। উন্নততর আর্যধর্ম ও সভ্যতার প্রবল প্রাধান্যে বাঙালি আংশিকভাবে আর্য সংস্কৃতি গ্রহণ করেছিল। তবে সাধারণ মানুষ নিজেদের দেবদেবীকেন্দ্রিক ব্রত-পূজা ত্যাগ করেনি। মুসলমান আক্রমণের ফলে সর্বস্তরের সহায়হীন বাঙালি খুঁজেছিল শক্তিমানের আশ্রয়। তাই সমাজের উচ্চস্তরে প্রচলিত পৌরাণিক দেবদেবীদের সঙ্গে প্রতিহিংসাপরায়ণ অথচ ভক্ত ইচ্ছা পুরণকারী লোকদেবতাদের মিলনে দেখা দিল নতুন এক শ্রেণির দেবদেবী। দেবতার নিকট আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বিপদমুক্তির পথ খুঁজেছিল মানুষ। তাই লোকদেবতা মনসা, চণ্ডী ও ধর্ম উপাসনা ক্রমে প্রাধান্য লাভ করে। আর তখনই সমাজের উচ্চস্তরের সংস্কৃতজ্ঞ কবিগণ–লৌকিক আখ্যানের সঙ্গে শাস্ত্র পুরাণের গঠনরীতি মিশিয়ে, স্বীয় কল্পনারসে জারিত করে রচনা করলেন মঙ্গলকাব্য। এই কাব্য শ্রবণের ফল জাগতিক ও পারলৌকিক সর্ববিধ মঙ্গল।
মঙ্গলকাব্যের নায়ক-নায়িকারা ছিলেন বণিক এবং নিম্নশ্রেণির মানুষ, কদাচিৎ স্থানীয় রাজা। হিন্দু রাজত্বকালে বাংলার বিস্তৃত সমুদ্র বাণিজ্যের স্মৃতিও মঙ্গলকাব্যের কাহিনির আবহ রচনা করেছিল। নিম্নশ্রেণির মানুষের আরাধ্য দেবদেবী উচ্চ স্তরে গৃহীত হয়েছেন সময়ের ও অবস্থার প্রেক্ষিতে। এই সমাজ পরিবর্তনের দিকটিও ধরা পড়েছে মঙ্গলকাব্য রচনায়। আত্মশক্তিতে দৃঢ়বিশ্বাস যখন অপগত হয়, তখনই কোনো দেশ বা জাতি ভক্তিমার্গ আশ্রয় করে। কারণ ভক্তির মূল কথা নিঃশেষে আত্মসমর্পণ। মুসলমান আক্রমণ বাঙালির মন থেকে মুছে দিয়েছিল আত্মবিশ্বাসের শেষ কণা। ফলে দেবদেবীনির্ভর পাঁচালি ধরনের ক্ষুদ্র আখ্যানসমষ্টিই কাব্যরূপে প্রাধান্য পেয়েছিল।
আবার অনেক পণ্ডিত মনে করেন, আর্য ও অনার্য সংস্কৃতির মিশ্রণের ফল মঙ্গল কাব্য। আক্রমণের অনেক আগে থেকেই বাংলার লোকধর্ম আর উচ্চ অধ্যাত্ম ধারণাসম্ভূত পৌরাণিক ধর্ম পারস্পরিক মিলন ও মিশ্রণের মধ্য দিয়ে মানসিক আশ্রয় খুঁজতে শুরু করে।
পার্থিব ভোগলিপ্সু জনমানস নিজেদের তৃপ্তির জন্যই শুদ্ধ পুরাণসম্মত ভক্তিবাদের সঙ্গে লোকধর্মের ইহমুখীন ঐশ্বর্যপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মিশিয়ে গড়ে তুলেছিল কামনাপুরক দেবতার আদর্শ। এভাবেই গড়ে উঠেছিল মঙ্গলকাব্য সৃষ্টির পটভূমি ও আবহ।
মঙ্গলকাব্যের বৈশিষ্ট্য —
মঙ্গলকাব্য রচনার একটি নির্দিষ্ট কাঠামো আছে। এই কাঠামো মোটামুটি চার ভাগে বিভক্ত। (১) বন্দনা— এই অংশে পুরাণ প্রসিদ্ধ ও লোকখ্যাত নানা দেবদেবীর বন্দনা বা স্তবস্তুতি করা হয়। (২) গ্রন্থোৎপত্তির কারণ— এই অংশে প্রায়শ কবি আত্মপরিচয় দিয়ে গ্রন্থোৎপত্তির কারণ বিবৃত করতেন। প্রায় সব মঙ্গলকাব্যই দেবদেবীর নির্দেশে, স্বপ্নাদেশে রচিত একথাই লিখেছেন কবিগণ। (৩) দেবখণ্ড—এই অংশে পুরাণ বর্ণিত দেবতার সঙ্গে লোকদেবতার সম্বন্ধ তথা মিশ্রণ ঘটেছে। দেবতা বা দেবীত্ব পরিচয় দানে তা প্রকাশরূপ লাভ করেছে। 'মনসামঙ্গল' ও 'চণ্ডীমঙ্গলে' এ অংশে প্রাধান্য পেয়েছেন শিব। (৪) নরখণ্ড— এ অংশেই মঙ্গলকাব্যের মূল কথাবস্তু স্থান পেত, এ অংশে দেবতার পৃথিবীতে পূজা প্রচারের ইচ্ছা হেতু কোনো স্বর্গবাসীকে শাপ দিয়ে মর্তে প্রেরণের কথা আছে। শাপভ্রষ্ট স্বর্গবাসীর নানা বিপদ ও দেবদেবীর পূজা দ্বারা ত্রাণ লাভ এবং শেষে স্বর্গবাসীর পুনরায় স্বর্গগমন এ অংশের উপজীব্য। নরখণ্ড বর্ণনার মধ্যে কয়েকটি আঙ্গিক পরিদৃষ্ট হয়। বারমাস্যা ও চৌতিশা সেগুলির মধ্যে অন্যতম। বারমাস্যায় কাব্যের নায়িকার বারো মাসের সুখ-দুঃখের কাহিনি বর্ণিত আছে। চৌতিশায় আছে বিপন্ন নায়ক-নায়িকা কর্তৃক চৌত্রিশ অক্ষরযোগে ইষ্টের স্তবস্তুতি।