নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ

 গিরিশচন্দ্র ঘোষ

গিরিশচন্দ্র ঘোষ


গিরিশচন্দ্র ঘোষ একাধারে প্রখ্যাত নট-নাট্যকার-নাট্য পরিচালক ছিলেন। তার পূর্ণাঙ্গ নাটকের সংখ্যা প্রায় ৫০ । পাশাপাশি রয়েছে বেশকিছু প্রহসন , রূপক নাটক, গীতিনাট্য —এই সব মিলিয়ে তাঁর নাটকের সংখ্যা প্রায় শতাধিক। তবে কালের বিচারে গিরিশচন্দ্রের বহু নাটক উত্তীর্ণ হতে পারেনি। তবে তিনি যে বাংলা নাট্য সাহিত্যের প্রত্যেক পুরুষ তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রথম জীবনে তিনি শ্যামবাজার নাট্য সমাজের সঙ্গে ।পরবর্তীকালে তিনি ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগদান করেন । তিনি ছিলেন ন্যাশনাল থিয়েটার এর নাট্য আন্দোলনের নায়ক এবং স্টার থিয়েটার ও অন্যান্য রঙ্গমঞ্চে বিশেষ সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করেন। দর্শকদের চাহিদা পূরণ করার জন্য তিনি প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস এবং মধুসূদনের কাব্য থেকে নাট্যরূপ দিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করেছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি নিজেই ঐতিহাসিক, সামাজিক, পৌরাণিক ও ভক্তিমূলক নাটক রচনা করেন।

নাটকের শ্রেণীবিভাগ:

(১) গীতি নাটক : 'আগমনী' (১৮৭৭), 'অকাল বোধন' (১৮৭৭), 'দেবলীলা' (১৮৭৮), ‘মোহিনী প্রতিমা' (১৮৮২), 'স্বপ্নের ফুল' (১৮৯৩),  'অশ্রুধারা' (১৯০১)  ইত্যাদি।

(২) ভক্তিমূলক ও পৌরাণিক নাটক : 'রাসলীলা' (১৮৮১), 'রাবণবধ' (১৮৮১), 'লক্ষণ বর্জন' (১৮৮১), 'অভিমন্যুবর্ধ (১৮৮১), ‘সীতার বনবাস' (১৮৮২), 'পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস' (১৮৮৩), 'দক্ষযজ্ঞ' (১৮৮৩), 'নল দময়ন্তী' (১৮৮৩), 'প্রহ্লাদ চরিত্র' (১৮৮৪), চৈতন্যলীলা (১৮৮৪), 'বুদ্ধদেব চরিত' (১৮৮৫), 'বিল্বমঙ্গল' (১৮৮৮), 'জনা' (১৮৯৩), 'পান্ডব গৌরব (১৯০০) ইত্যাদি।

(৩) ঐতিহাসিক নাটক:  'আনন্দ রহো' (১৮৮১), 'চন্ড' (১৮৯০), 'কালাপাহাড় (১৮৯১), 'ভ্রান্তি' (১৯০২), 'সৎনাম' (১৯০৪), 'সিরাজদ্দৌলা' (১৯০৬), 'মীরকাশিম' (১৯০৬), 'ছত্রপতি শিবাজী' (১৯০৭), 'অশোক' (১৯১১) ইত্যাদি।

(৪) সামাজিক নাটক :  'প্রফুল্ল (১৮৮৯), 'হারানিদি' (১৮৯০), 'মায়াবসান' (১৮৯৭), 'বলিদান’ (১৯০৫), 'গৃহলক্ষ্মী' (১৯১২) ইত্যাদি। 

(৫) কৌতুকমূলক ব্যঙ্গাত্মক প্রহসন : 'ভোটমঙ্গল' (১৮৮২), 'হীরার ফুল' (১৮৮৪), ‘সভ্যতার পাণ্ডা' (১৮৮৩), 'সপ্তমীতে বিসর্জন' (১৮৮৫), 'বেল্লিক বাজার' (১৮৮৬), 'বড়োদিনের বকশিস (১৮৯৩), 'য্যায়সা কা ত্যায়সা' (১৯০৬), 'শাস্তি কি শান্তি' (১৯০৮)ইত্যাদি।

(৬) নাট্যরূপায়ণ : ‘কপালকুণ্ডলা' (১৮৭৩), 'বিষবৃক্ষ' (১৮৭৪), 'দুর্গেশনন্দিনী' (১৮৭৮), 'মেঘনাদবধ কাব্য' (১৮৭৭), 'যমালয়ে জীবন্ত মানুষ' (১৮৭৭), 'পলাশির যুদ্ধ' (১৮৭৮), 'চোখের বালি' (১৯০৭) ইত্যাদি৷

গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে কতগুলি অবতার ও মহাপুরুষ বিষয়ক মহাপুরুষদের বন্দনা, তাঁদের অলৌকিক লীলা সেইসব নাটকের বিষয়বস্তু হয়েছে। রামকৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করার পর গিরিশচন্দ্র মহামানবদের মধ্যে দেবতাকে প্রত্যক্ষ করেছেন। এই পর্যায়ের তাঁর বিখ্যাত নাটকগুলি হল, গিরিশচন্দ্রের পৌরাণিক নাটকগুলির মধ্যে 'জনা' (১৮৯৩) হল শ্রেষ্ঠ। পুত্রের মৃত্যুতে উন্মাদিনী জনার চরিত্র, জনার শিবভক্ত পুত্র প্রবীর, জনার স্বামী নীলধ্বজ, প্রবীরের শোকে স্ত্রী মদনমঞ্জরীর প্রাণত্যাগ, সবই পুরাণাশ্রয়ী। 'বিল্বমঙ্গল' (১৮৮৮) ভক্তিরসের প্রাচুর্যে সেইসময় নাট্যমঞ্চে প্লাবনের ঢেউ তুলেছিল। ধর্ম সম্পর্কে গিরিশচন্দ্রের মত ছিল অত্যন্ত উদার। রামকৃষ্ণদেবের মতোই তিনি মনে করেন 'যত মত তত পথ' এই কারণেই তিনি 'চৈতন্য লীলার' পাশাপাশি 'বুদ্ধদেব চরিত্র', 'বিল্বমঙ্গল' এবং শঙ্করাচার্যের মতে পেরেছিলেন।

গিরিশচন্দ্র পৌরাণিক নাটক লিখে জনপ্রিয় হলেও, তিনি বেশকিছু দেশপ্রেম মূলক ইতিহাস আশ্রয়ী নাটক লিখেছেন। দেশ প্রেমমূলক ইতিহাস আশ্রয়ী নাটকে নাট্যকার ভারতবর্ষের ইতিহাসের বীর নায়কদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন। শিক্ষিত মানুষের সচেতনতা, দেশাত্মবোধ, জাতীয়তাবাদ, এইসব নাটকে লক্ষ্য করা যায়। তিনি যুগের দাবী মেটাতে গিয়ে ইতিহাসের দাবী সর্বদা মেটাতে পারেননি। তবে তিনি ইতিহাস আশ্রয়ী নাটকে দেশাত্মবোধের প্রচার করতে চেয়েছেন এবং তিনি পেরেছেন।

সমসাময়িক বাংলার সমাজ সমস্যাকে গিরিশচন্দ্র তাঁর সামাজিক নাটকের বিষয় করেছেন। সমাজ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, সুখ-দুঃখ, সমাজ ও ব্যক্তির জীবন সমস্যার, পারিবারিক জীবনের সমস্যাকে কেন্দ্র করে সামাজিক নাটক গুলি লিখেছেন। এই শ্রেণীর নাটকে পৌরাণিক নাটকের অলৌকিকতা বা ঐতিহাসিক নাটকের ইতিহাস খ্যাত ব্যক্তিদের পরিবর্তে সাধারণ মানুষ প্রাধান্য লাভ করেছে। তাঁর শ্রেষ্ঠ সামাজিক নাটক 'প্রফুল্ল'। এই নাটকে সম্পত্তির লালসাকে কেন্দ্র করে মেজ ভাই রমেশ কীভাবে বড় ভাই যোগেশ ও ছোট ভাই সুরেশকে প্রবঞ্চনা করে তার নির্মল চিত্র তুলে ধরেছেন।

সমাজ জীবনের সমস্যা নিয়ে গিরিশচন্দ্র যেমন ট্রেজিডি রচনা করেছেন, তেমনি আবার সেই সমস্যাকে কেন্দ্র করে কমেডি রচনা করেছেন। গিরিশচন্দ্রের সময়ে কলকাতা শহরে বাবুরা ব্যভিচারে মতো হয়েছিল। রঙ্গ কৌতুক মূলক ব্যঙ্গাত্মক রচনা উদ্দেশ্য ছিল সামাজিক দিক থেকে সমাজের সামনে তুলে ধরা ও হাস্যরস সৃষ্টি করা। 'বলিদান' নাটকের পরিচয় আমরা পেয়েছি।

গিরিশচন্দ্র নাটক রচনা ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে বাংলা নাট্যশালা ও নাট্যসাহিত্যকে শিখরে তুলেছেন। তাকে বাদ দিয়ে বাংলা নাট্যশালা কিংবা নাট্য সাহিত্যের ইতিহাস রচনা সম্ভব নয়।

নবীনতর পূর্বতন