বাংলা সাহিত্য ও সমাজে চৈতন্যদেবের প্রভাব

 বাংলা সাহিত্য ও সমাজে চৈতন্যদেবের প্রভাব



বৈষ্ণব সাহিত্য রচিত না হলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য কখনোই গৌরব করতে পারত না। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের ইতিহাস যে গতানুগতিকতার ধূলি-ধূসর পথ ছেড়ে প্রেম, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মলোকের আলোক তীর্থযাত্রা করেছে, তার প্রধান কারণ—বৈষ্ণব সাহিত্য, এবং এবং সাহিত্যের মূল উৎস শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনী কথা। চৈতন্যদেব আবির্ভাব না হলে বৈষ্ণব সাহিত্যের ঐশ্বর্য্যের মূর্তি বিকশিত হতে পারত না। চৈতন্যদেব কোনো ধর্ম প্রচার করেননি। প্রচলিত অর্থে প্রচারকও তিনি ছিলেন না। কিন্তু তিনি সমাজে আনতে চেয়েছিলেন সমতা। তখনও সমাজে ছিল মুষ্টিমেয় সম্পদবানেরই প্রাধান্য আর দরিদ্র জনতার দিন কাটত দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রামে এবং নীরবে শক্তিমানের অত্যাচার সহ্য করে।

এ ছাড়া ছিল ভিন্ন ধর্মের প্রসার। হিন্দু সমাজে স্পৃশ্য অস্পৃশ্যের প্রবলতা ছিল, দলিত বর্গের মানুষ ছিল ঘৃণা ও অবহেলার পাত্র। নবাগত ইসলামের সাম্যের আদর্শ তাদের আকর্ষণ করেছিল, বাংলায় ইসলাম প্রসারিত হচ্ছিল অতি দ্রুত। তার প্রতিবিধানের জন্যে বাঙালি নিয়েছিল স্মৃতিশাস্ত্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণের পথ। কথায় নয়, কর্মেই চৈতন্য আনলেন প্রতিবাদ। তিনি ধনী-দরিদ্রকে দেখতেন সমদৃষ্টিতে। তাই খোলাবেচা শ্রীধরের একমাত্র সম্বল লোহার পাত্রে করেছিলেন জলপান। ধনীর ছেলে রঘুনাথ দাসকে দিয়েছিলেন দারিদ্র্যের দীক্ষা। তিনি মানুষকে দিতেন সর্বাধিক গুরুত্ব। মানুষ নিজেকে হীন দরিদ্র মনে করবে দুঃখী বলে আপনাকে অবজ্ঞা করবে—চৈতন্য এমন দৃষ্টিভঙ্গির বিরোধী। ছিলেন। তিনি সহ্য করতে পারতেন না নিকৃষ্টতাসূচক ব্যক্তিনাম। শ্রীবাসের গৃহে 'দুঃখী' নামের পরিচারিকার নাম তিনি দিয়েছিলেন সুখী। সুবুদ্ধি মিশ্রের পুত্রের বাল্যনাম ‘গুহিয়া' পালটে চৈতন্যই দিয়েছিলেন '‘জয়ানন্দ'।

অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধেও ছিল তাঁর প্রতিবাদ। তাই নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ গৃহের সন্তান হয়েও তিনি ঘোষণা করেছিলেন—

“চণ্ডালোহপি দ্বিজশ্রেষ্ঠো হরিভক্তিপরায়ণঃ।ভুহরিভক্তিবিহীনস্তু দিজোহপি শ্বপচাধমঃ।”

"চণ্ডাল চণ্ডাল নহে যদি হরি ভজে।
ব্রাহ্মণ চণ্ডাল হয় যদি হরি ত্যাজে॥”

আড়ম্বরপূর্ণ বহিরঙ্গ ধর্মাচরণের পক্ষপাতী ছিলেন না চৈতন্যদেব। হরি নামেই মুক্তি—এই ছিল তাঁর ঘোষণা নামকীর্তনের ওপর জোর দিয়েছিলেন তিনি।

চৈতন্যদেবের আচরণে এবং মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বাংলার সমাজে স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের বিভাগ কিছুটা শিথিল হয়েছিল। কমে গিয়েছিল ধর্মান্তরের প্রবল প্রবাহ। ব্রাহ্মণসমাজ যাদের অল্প অপরাধে ত্যাগ করেছিল, চৈতন্যদেব প্রভাবিত বৈষ্ণবধর্ম তাকে দিয়েছিল আশ্রয়। তাই চৈতন্য প্রভাবে বাংলার সমাজ সংহত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল একথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেই হয়।

চৈতন্যের প্রদর্শিত কৃষ্ণভজনের মধ্যে একটি বিষয় ছিল নিত্য কৃষ্ণবিষয়ক পাঠ। তাই বৈষ্ণবদের মধ্যে শিক্ষা হয়েছিল বিস্তৃত। মেয়েদের মধ্যেও শিক্ষার প্রসার ঘটেছিল। উনিশ শতকে বাংলার সম্ভ্রান্ত গৃহে মেয়েদের পড়ানোর জন্য আসতেন বৈষ্ণবী ঠাকুরানি। ইতিহাসই এ সত্যের সাক্ষ্য দেয়। এক্ষেত্রেও তিনশো বছর ব্যাপী চৈতন্য প্রভাবই কাজ করেছে বলা যায়। প্রসঙ্গত, স্মরণীয়, বৈষ্ণবসমাজে নারীকে মর্যাদা দেওয়া হত। মেয়েরাও দীক্ষাদানের অধিকার পেয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও চৈতন্য প্রভাবই কাজ করেছে। চৈতন্যের প্রিয় ছিল কৃষ্ণনাম এবং কৃষ্ণবিষয়কপদ কীর্তন। আবার বৈষ্ণবের নিত্যকৃত্য ছিল কৃষ্ণকথা পাঠ ও শ্রবণ। তার ফলে চৈতন্য পরবর্তী বাংলার বৈষ্ণব পদাবলি হয়ে উঠেছিল আধ্যাত্মিকতার ঐশ্বর্যে সম্পদবান। তারই সঙ্গে এসেছিল অনুভবের গাঢ়তা সংবেদনশীলতা। এক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্য চৈতন্যদেবের কাছে গভীরভাবে ঋণী।

চৈতন্যের সাধনার পথ ছিল অনুরাগের পথ। তিনি ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে প্রেমসম্বন্দ্ব প্রচার করেছিলেন। তাঁর লেখা 'শিক্ষাষ্টকে' আছে তারই প্রকাশ। এই শিক্ষাষ্টক ছাড়া তাঁর প্রচারের কোনো লিখিতরূপ নেই। কৃষ্ণবিরহে তাঁর দিব্যোন্মাদ অবস্থা দেখে বাঙালি কবি বিরহিণী রাধার ব্যাকুলতার অনুধাবনে ও চিত্রনে সক্ষম হয়েছিলেন। চৈতন্য-পরবর্তী বাংলা সাহিত্য তাই এত ঐশ্বর্যময় হয়ে উঠেছিল। চৈতন্য পরবর্তী যুগে বৈষ্ণবধর্মের বিস্তৃতির কারণে বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি ধারার সূচনা হয়। এর আগে বাংলা সাহিত্য ছিল পুরোপুরি দেবনির্ভর। চৈতন্য প্রভাবে বাঙালি মূলত মানুষকে কেন্দ্র করে সাহিত্য রচনায় সক্ষম হল। দেখা দিল বাংলা সাহিত্যের নতুন এক শাখা জীবনীসাহিত্য। শুধু চৈতন্য নন, অন্যান্য বৈষ্ণবভক্তদের জীবনীও রচিত হয়েছিল। সেগুলির মধ্যে আমরা নাম করতে পারি অদ্বৈতাচার্যের জীবনী 'অদ্বৈত মঙ্গল' আর অদ্বৈত-পত্নী সীতাদেবীর জীবনী 'সীতাগুণ কদম্ব' (লেখক বিষ্ণুদাস আচার্য) আর ‘সীতাচরিত্র' (লেখক লোকনাথ দাস)। এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হবে, বাংলার সমাজ ও সাহিত্য সংহত ও সমৃদ্ধ করেছিল চৈতন্যের আশ্চর্য দিব্যজীবন এবং তাঁর মতবাদের প্রভাবে।

নবীনতর পূর্বতন