আরাকান কবি সৈয়দ আলাওল

আরাকান কবি সৈয়দ আলাওল



সৈয়দ আলাওলের ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বিস্তৃত আকারে জানা যায়নি তবে তাঁর রচিত কাব্যের মধ্য দিয়ে তাঁর জীবনকাহিনি ধরা পড়ে।মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলমান কবিদের মধ্যে সৈয়দ আলাওল সর্বাধিক প্রচারিত। তাঁকে কেউ কেউ মধ্যযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ মুসলমান কবি বলে মনে করেন। সেকেন্দারনামা ও সয়ফুলমুলকে কবির বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া যায়। অনুমান ১৬শ শতাব্দীর প্রান্তভাগে চট্টগ্রামের কোনো এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অন্য মতে ফরিদপুরে। আলাওলের পিতা ছিলেন এক উচ্চ রাজকর্মচারী। ভাষাজ্ঞান ছিল তাঁর অসাধারণ। তেমনি তাঁর সংগীত জ্ঞানেরও পরিচয় পাওয়া যায়। সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, ফারসি ভাষায় সৈয়দ আলাওলের জ্ঞান ছিল সর্বজনবিদিত। কিশোর জীবনে পিতৃহারা হলে সৈয়দ আলাওল মাগন ঠাকুরের সেনাবাহিনীতে চাকরি নিতে বাধ্য হন। অল্পদিনের মধ্যে আরাকানের অভিজাত মুসলমান সমাজে তাঁর কবিত্ব, সঙ্গীত পারদর্শিতা প্রভৃতি গুণের কথা প্রচারিত হয় এবং  সহকর্মীদের অনুরোধে রচনা করেন 'পদ্মাবতী' কাব্য। হিন্দি কাব্য ‘পদুমাবৎ' অবলম্বনে ‘পদ্মাবতী' রচিত হয়। আরাকানের প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুর, অর্থমন্ত্রী সুলেমান, প্রসিদ্ধ কবি সৈয়দ মুসা, সৈয়দ মসুদ শাহ এবং আরাকানরাজ শ্রীচন্দ্র সুধর্মার নির্দেশে তিনি অনেকগুলি কাব্য অনুবাদ করেন। যেমন— তোহফা সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল, হপ্ত পয়কর, সেকেন্দারনামা প্রভৃতি রচনা করেন।

আলাওলের সব কাব্যই আরবি, ফারসি ও হিন্দি কাব্যের অনুবাদ বা ভাবানুবাদ। ‘লোরচন্দ্রাণী’ বা ‘সতীময়না’ এবং তাঁর অন্যান্য কাব্য—(১) ‘পদ্মাবতী’ (আনুমানিক ১৬৪৬), (২) 'লোরচন্দ্রাণীর উত্তরাংশ ১৬৫৯, (৩) 'সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল’(১৬৫৮-১৬৭৫), (৪) (হপ্ত) সপ্ত পয়কর' (১৬৬০), (৫) 'তোহফা' (১৬৬০-১৬৬১), (৬) ‘সেকেন্দার নামা’ (১৬৭২)। মধ্যযুগের কোনো কবিই এতগুলি কাব্য অনুবাদ করেননি। আলাওলের অনুবাদ স্বচ্ছন্দ এবং কোনো কোনো স্থলে কবির মৌলিক রচনাশক্তির পরিচয় পাওয়া যায়। কবি আলাওল বহু বৈষ্ণবপদও রচনা করেছিলেন।

‘পদ্মাবতী’-ই আলাওলের সবচেয়ে বিখ্যাত অনুবাদ। হিন্দিতে লেখা মোহম্মদ জায়সির ‘পদুমাবৎ' নামের আধ্যাত্মিক রূপক কাব্যের এই অনুবাদ আলাওল রচনা করেন মাগনঠাকুরের আদেশে। স্বয়ং সুফি মতাবলম্বী ছিলেন কবি। তাই অনুবাদের স্থানে স্থানে তিনি গভীর আধ্যাত্মিক কাব্যরূপ দিয়েছেন পয়ার দ্বিপদী ছন্দে। চিতোরের রানী পদ্মিনী ও সুলতান আলাউদ্দিন সম্বন্ধে অনেক গল্প কাহিনী রাজস্থানে প্রচলিত আছে। চিতোর-রাজ রত্নসেনের রানী পদ্মিনী বা পদ্মাবতীর রূপ-গুণের খ্যাতি সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই শুনে দিল্লির পাঠান সুলতান আলাউদ্দিন খিলজী চিতোর আক্রমণ করে পদ্মাবতীকে বলপূর্বক কেড়ে নিতে আসেন। যুদ্ধে রত্নসেন ও তাঁর অনুচরেরা প্রাণ দেন, পদ্মাবতী নিজ নারীধর্ম রক্ষা করার জন্য সখীদের সঙ্গে অগ্নিশিখায় আত্মহত্যা করেন। এ কাহিনী রাজস্থানের গায়কসম্প্রদায় রাজস্থানি উপভাষায় এখনও গান করে থাকেন। কিন্তু পদ্মাবতী (পদ্মিনী) আলাউদ্দিন ঘটিত কাহিনীটি ঐতিহাসিক কি না তা নিয়ে গভীর সন্দেহ আছে।  তাঁর ‘পদ্মাবতী’ প্রকৃতই রোমান্টিক-ঐতিহাসিক কাব্য, যদিও ইতিহাসের উপাদান সামান্যই। এর সঙ্গে কোনো ধর্মীয় ভাব বা রূপক তাৎপর্য জড়িয়ে নেই।

যেমন 'প্রেমভাবে সংসার সৃজিল করতার’। তবে 'সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল' আরব্য উপন্যাসের একটি কাহিনি অবলম্বনে রচিত ফারসি ভাষায় লেখা মুসলিম নীতিশাস্ত্রের অনুবাদ মুসলিম সমাজে জনপ্রিয় ছিল। ‘সপ্ত’ বা ‘হপ্তপয়কর’ নিজামির ফারসি কাব্য হণ্ডনৈকরের স্বাধীন অনুবাদ। রাজা বহুরাম সাতটি টঙ্গীতে বাসকারিণী সাত রানির কাছে সাতদিনে যে সাতটি গল্প শোনেন। ‘সপ্তপয়কর’ সেই সাত কাহিনির সংকলন। ‘সেকেন্দরনামা' আলাওলের শেষ রচনা, এই কাব্যটি নিজামির ফারসি কাব্য 'ইসকন্দর নামার’ অনুবাদ। আলেকজান্ডারের বিজয় অভিযান সম্পর্কে ইরানে প্রচলিত সাত কাহিনির বঙ্গানুবাদ।

আলাওল অদ্বিতীয় স্রষ্টা নন, নতুন দিনের বার্তাবহ। তাঁর বিশেষত্ব (১) মানবীয় প্রেমের সঙ্গে আধ্যাত্মিক প্রেমসাধনার মিলন তাঁর কাব্যকে করেছে বিশিষ্ট। (২) বাঙালির সাহিত্য ভাষা ব্রজবুলির সঙ্গে ফারসি, আরবি কথাবস্তু, ইতিহাস চেতনা এবং ধর্মনীতিকে সাহিত্যের বিষয় করে তিনি সাহিত্যের পরিধিকে ব্যাপ্ত করেছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যকে করেছেন অসাম্প্রদায়িক। (৩) বাংলা সাহিত্যে তিনি গঠনসৌকর্য, প্রাঞ্জলতা ও প্রসাদগুণ এনে দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ তাঁর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া গেল—

"যোগী সকলের দেব আপ্ত মহাজন।
সকল দেবের দেব প্রভু নিরজন।।"

"ব্রহ্ম চিনে ভাব নাচি, ভাব চিনে রস।
ত্রিভুবনে যত দেখ প্রেম হস্তেরণ।।"

পাণ্ডিত্য ও সংকীর্ণতা মুক্ত আধ্যাত্মিকতার প্রকাশে আলাওল বাংলা সাহিত্যকে করেছেন নাগরিক এবং জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে সকল বাঙালির সাহিত্য।

নবীনতর পূর্বতন