দ্বিজেন্দ্রলাল রায়(১৮৬৩-১৯১৩)
দ্বিজেন্দ্রলাল একাধারে কবি, নাট্যকার, সঙ্গীত রচয়িতা, গায়ক এবং একজন স্বদেশপ্রেমিক।রচনার আঙ্গিক, ভাষা ও ভাবের দিক থেকে তিনি বাংলা নাটকের মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন দিকের আগমন ঘটালেন। নাট্য সাহিত্যে তাঁর অবদান মূলত ঐতিহাসিক নাট্যকার রূপে। উনিশ শতকের বাংলাদেশে নবচেতনার বিকাশে তাঁর নাটকগুলির ভূমিকা ছিল অসামান্য।
দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যরচনাকে চার শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—
(১) ঐতিহাসিক নাটক: 'তারাবাঈ’(১৯০৩), ‘প্রতাপসিংহ’(১৯০৫), ‘দুর্গাদাস’(১৯০৬), ‘নুরজাহান’(১৯০৮), ‘মেবার পতন’(১৯০৮), ‘সোরভ রুস্তম’(১৯০৮), ‘সাজাহান’(১৯০৯), ‘চন্দ্রগুপ্ত’(১৯১১), ‘সিংহল বিজয়’(১৯১৫)।
(২) সামাজিক নাটক: ‘পরপারে’(১৯০০), ‘বঙ্গনারী’(১৯১৬)।
(৩) পৌরাণিক নাটক: ‘পাষাণী’(১৯০০), ‘সীতা’(১৯০৮), ‘ভীষ্ম’(১৯১৪)।
(৪) প্রহসন: ‘একঘরে’(১৮৮৯), ‘কল্কি অবতার’(১৮৯৫), ‘বিরহ’(১৮৯৭), ‘ত্র্যহস্পর্শ’(১৯০০), ‘প্রায়শ্চিত্ত’(১৯০২), ‘পুনর্জন্ম’(১৯১১), ‘আনন্দ বিদায়’(১৯১২)।
ঐতিহাসিক নাটক: দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা ঐতিহাসিক নাটকের শ্রেষ্ঠ শিল্পী।
তারাবাঈ(১৯০৩) দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম ইতিহাসাশ্রিত নাটক। নাটকের মূল বৃত্তান্ত রাজস্থান থেকে গৃহীত। জাতীয় আন্দোলনের পাশাপাশি যে নারী মুক্তি আন্দোলন সেই সময় চলে ছিলো সে দিকের প্রতি দৃষ্টি রেখে নাট্যকার তারাবাঈ চরিত্র কে অঙ্কন করেছেন। তাই তারাবাঈ দ্বিজেন্দ্রলালের স্ত্রী স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় রূপলব্ধ। এই নাটকে কল্পিত চরিত্র তারাবাঈ এর মা সুরতান রাখি। এই চরিত্রটি সৃষ্টির প্রেরণায় রয়েছে স্বদেশ প্রেম। চরিত্র-পৃথ্বীরাজ, তারাবাঈ।
প্রতাপ সিংহ (১৯০৫) নাটকের ইতিহাসের প্রতাপ সিংহের স্বদেশ ভাবনা রূপায়িত হয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলালের যথার্থ স্বদেশ প্রেম মূলক রচনা প্রয়াস প্রতাপ সিংহ থেকে শুরু হয়। নাট্যকার প্রতাপ সিংহ কে জাতীয় বীর রূপে গ্রহণ করেছেন।স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় নাট্যকার বীরশ্রেষ্ঠ প্রতাপ সিংহের শৌর্য, বীর্য, দেশপ্রেম ও অতুলনীয় আত্মত্যাগের মহিমায় চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। দ্বিজেন্দ্রলাল বুঝেছিলেন-দেশ প্রেম যদি জাগ্রত করতে হয় তাহলে মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হবে, পরস্পরের মধ্যে ঈর্ষা দ্বেষ ও ভেদাভেদ ভুলতে হবে। হিন্দু মুসলমানের ঐক্যবদ্ধ আকবর গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
টডের ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অফ রাজস্থান’ কে কেন্দ্র করে দ্বিজেন্দ্রলাল দুর্গাদাস নাটক রচনা করেন। দুর্গাদাস এর মধ্য দিয়ে নাট্যকার স্বদেশ প্রেমের ভাব উদ্দীপনার সঞ্চার করতে চেয়েছেন। বঙ্গভঙ্গের পটভূমিকায় যে বিরক্ত সেদিন বাঙালি আশা করেছিলেন, নাট্যকার দুর্গাদাসের মধ্যে সেই বীরত্বকে তুলেছেন ধরেছেন। দুর্গাদাস ও কাসিম এবং কাসিম ও দিলীপ খাঁর মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলমানের মিলন প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।