সবুজ পত্র (১৯১৪-১৯২৮)
প্রমথ চৌধুরীর সম্পাদনায় কলকাতা থেকে ১৩২১ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ (মে ১৯১৪) মুদ্রিত হয় ‘সবুজ পত্র'। নন্দলাল বসুর আঁকা সবৃন্ত তালপাতার চিত্রযুক্ত প্রচ্ছদ নিয়ে প্রকাশিত বিজ্ঞাপন ও ছবিহীন পত্রিকাটি চলেছিল ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। পত্রিকাটির মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী বাঙালিকে দিতে চেয়েছিলেন নতুনকালের ভাবনাচিন্তা ও মননশীলতার দীক্ষা। এই পত্রিকায় মুদ্রিত হত পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে আলোচনামূলক প্রবন্ধ এবং চিন্তনমূলক প্রবন্ধ।
বৈশিষ্ট্য : এই পত্রিকার বিশেষত্ব ছিল ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান আর প্রাচীন ও আধুনিক ভারতের নতুন রাজনীতি অর্থনীতি সাহিত্য-দর্শনের সম্মিলনে বাঙালির মনকে সংস্কার ও ভাবালুতা থেকে মুক্তিদানের প্রয়াস। মননপ্রধান, যুক্তিনিষ্ঠ, বলিষ্ঠ সাহিত্য নির্মাণে উৎসাহ দিতে চেয়েছিল এই পত্রিকা। মার্জিত চলিত বাংলাকে সর্ববিধ সাহিত্যকর্মের মাধ্যম করে তোলাও ছিল এ পত্রিকার অন্যতম বিশেষত্ব।
লেখকগোষ্ঠী : 'সবুজ পত্র'-এর প্রধান লেখক ছিলেন রবীন্দ্রনাথ এবং প্রমথ চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ সমাজ সমালোচনামূলক বলিষ্ঠ লেখা মুদ্রিত হয়েছে ‘সবুজ পত্র'-এ। তাঁর 'চতুরঙ্গ' ও 'ঘরে-বাইরে' (উপন্যাস), 'হালদার গোষ্ঠী', 'স্ত্রীর পত্র’, ‘হৈমন্তী' প্রভৃতি নতুন মনোভাব ও রীতির উপন্যাস ও গল্পের নাম প্রসঙ্গত মনে করা যায়। প্রমথ চৌধুরীর 'ফরমায়েশি গল্প'—'চার ইয়ারী কথা' এ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়েছিল। অন্যান্য নিয়মিত লেখকদের মধ্যে অনেকেই লিখেছেন পৃথক ধরনের গল্প। প্রসঙ্গত মনে করা যায়, মাধুরীলতা দেবীর 'সুয়ো' (আষাঢ় ১৩২২ বঙ্গাব্দ), সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্যের আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত গল্প ইরা'র (ফাল্গুন, ১৩২৪ বঙ্গাব্দ) কথা।
‘সবুজ পত্র' প্রবন্ধ-সম্পদেও ছিল ধনী। চলিত ভাষায় গম্ভীর সাহিত্যের আলোচনা করতে চেয়েছিল সবুজ পত্র’। তাই ভাষা বিষয়ে বহু প্রবন্ধ বের হয়েছিল এ পত্রিকায়।
বিজ্ঞান, সাহিত্য-সমালোচনা, সাহিত্যতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে ‘সবুজ পত্রে’ নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন রবীন্দ্রনাথ, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, কিরণশঙ্কর রায়, হারীতকৃষ্ণ দেব, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বরদাচরণ গুপ্ত, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সুরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুরেশ চক্রবর্তী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানি ও প্রমথ চৌধুরী।
‘সবুজ পত্র’ কবিতা বিশেষ করে নতুন রীতির কবিতা প্রকাশে উৎসাহী ছিল। প্রমথ চৌধুরীর নতুন ধরনের কবিতা, বিদেশি ছন্দে লেখা কবিতা ভিন্ন রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’ পর্বের মুক্ত ছন্দের বলিষ্ঠ প্রাণশক্তিতে দীপ্তিমান কবিতাগুলিও এই পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। প্রথম সংখ্যাতেই মুদ্রিত হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ‘সবুজের অভিযান' এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘সবুজ পাতার গান' কবিতা দুটি।
সংক্ষেপে বলা যায়—রচনারীতি সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি, মার্জিত চলিত গদ্যকে সাহিত্য মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠাদান, আধুনিকতম পাশ্চাত্য চিন্তন-মননের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় করিয়ে দেওয়া এবং মননপ্রধান সাহিত্য রচনায় বাঙালিকে প্রাণিত করা—এইসব কারণে ‘সবুজ পত্র’ বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয়।