জৈন ধর্ম || মহাবীর

জৈন ধর্ম||মহাবীর



জৈন ধর্ম : জৈন ধর্মের চব্বিশ জন তীর্থঙ্কর জৈন ধর্ম প্রবর্তন বা প্রচার করেছেন। তীর্থঙ্কর কথার অর্থ– মুক্তির পথ নির্মাতা বা পথপ্রদর্শক। জাগতিক দুঃখ অতিক্রম করার তীর্থ অর্থাৎ ঘাঁটি নির্মাণ করেছিলেন বলে জৈন ধর্মেমতের উৎপত্তির সঙ্গে যুক্ত চব্বিশ জন ধর্মগুরু তীর্থঙ্কর নামে পরিচিত। সর্বপ্রথম তীর্থঙ্কর ছিলেন ঋষভদের এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্কর হলেন মহাবীর। প্রথম বাইশজন তীর্থঙ্করের কোনও ঐতিহাসিক সন্ধান পাওয়া যায় না। ত্রয়োবিংশ তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ-ই ছিলেন জৈনধর্মের প্রকৃত প্রবর্তক, কিন্তু এ ধর্মকে সর্বসাধারণের মধ্যে প্রচার করে একটি প্রভাবশালী ধর্মে পরিণত করার কৃতিত্ব শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর-এর।

খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে কাশীর এক রাজবংশে পার্শ্বনাথের জন্ম। ত্রিশ বৎসর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করেন ও কঠোর সাধনার দ্বারা পরিপূর্ণ জ্ঞানলাভ করেন। অহিংসা, সত্য, অচৌর্য (চুরি না করা) ও অপরিগ্রহ (বিষয়-সম্পত্তির প্রতি অনাসক্ত থাকা)–এই চারটি আদর্শ হল পার্শ্বনাথ-প্রবর্তিত ধর্মের মূলমন্ত্র। এগুলি ‘চতুর্যাম’ নামে খ্যাত। মহাবীর এই চারটি নীতি গ্রহণ করে এবং তার সঙ্গে আরো একটি নীতি যোগ করেন। এই পঞ্চম নীতিটি হলো ব্রহ্মচর্য। এই পাঁচটি নীতি 'পঞ্চমহাব্রত' নামে পরিচিত।মুক্তিলাভের উপায় হিসেবে মহাবীর তিনটি পথ নির্দেশ করেছেন, যথা— সৎ বিশ্বাস, সং আচরণ ও সং জ্ঞান। এই তিনটি নীতি ত্রিরত্ন নামে খ্যাত। জৈনরা কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনে বিশ্বাসী ছিলেন। কর্মের বন্ধনই জীবকে অপবিত্র করে তোলে। কর্মফল ভোগ করতেই জীবের পুনর্জন্ম ঘটে। এই কর্মবন্ধন ছিন্ন করতে পারলেই জীবের মোক্ষ বা মুক্তিলাভ ঘটবে। এ ছাড়া‌ কৃচ্ছ্রসাধনকেই জৈনরা শাশ্বত সত্যকে জানার একমাত্র উপায় বলে মনে করতেন। অনশনরত অবস্থায় মৃত্যুকে পরম পুণ্যের পরিচায়ক বলে মনে করা হত।


মহাবীর : জৈন ধর্মের প্রবর্তক ছিলেন মহাবীর। মহাবীর আনুমানিক ৫৪০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৈশালীর উপকণ্ঠে কুন্দগ্রাম নামক স্থানে জ্ঞাতৃক নামাক ক্ষত্রিয় কুলে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সিদ্ধার্থ ও মাতা ছিলেন লিচ্ছবি বংশের রাজকন্যা ত্রিশালা। মহাবীরের পিতৃদত্ত নাম ছিলেন বর্ধমান। তরুণ বয়সে যশোদার সঙ্গে কার বিবাহ হয় এবং তার এক কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। ত্রিশ বছর বয়সে তিনি সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। দীর্ঘ বারো বছর তপস্যা করে 'জিন' বা 'জিতেন্দ্রিয়' নামে বিখ্যাত হন।সিদ্ধি লাভের মাধ্যমে তিনি সুখ-দুঃখকে জয় করে নিয়েছিলেন বলে তাঁর নাম মহাবীর হয়। 'জিন' থেকে তার শিষ্যদের জৈন বলা হয়। সিদ্ধি লাভের পর ত্রিশ বছর তিনি মগদ, অঙ্গ, কোশল, মিথিলা, নালন্দা, রাজগৃহ এবং উত্তর ভারতে নানা স্থানে ধর্ম প্রচার করেন। ৪৬৮ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে ৭২ বছর বয়সে রাজগৃহের কাছে পাবা নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন।

জৈনধর্ম প্রচার ও শ্রেণীবিভাগ : প্রথমে পূর্ব ভারত অর্থাৎ অঙ্গ, বিদেহ ও কোশল রাজ্যে প্রচলিত হয়। মগধ রাজ বিম্বিসার, অজাতশত্রু ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই ধর্মমতের সমর্থক ছিলেন। জৈনধর্মের প্রতি সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের এই অনুরাগ দাক্ষিণাত্যের বহু মানুষকে এই ধর্মগ্রহণে অনুপ্রাণিত করে। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষভাগে উত্তর ভারতে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে জৈন সন্ন্যাসী ভদ্রবাহু-র নেতৃত্বে বহু জৈন দক্ষিণ ভারতে চলে যান। বাকিরা স্থূলভদ্র-র নেতৃত্বে মগধেই থেকে যান ৷ ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যের জৈনরা মহাবীরের অনুশাসনগুলি কঠোরভাবে মেনে চলতেন। তাঁরা কোনও গ্রন্থি বা বস্ত্রধারণ করতেন না। এজন্য তাঁদের নাম হয় দিগম্বর। অপরপক্ষে, স্থূলভদ্রের নেতৃত্বে যে সব জৈনরা উত্তর ভারতেই ছিলেন তাঁরা শ্বেতবস্ত্র পরিধান করতেন। এজন্য তাঁদের নাম হয় শ্বেতাম্বর। দুই দলের বিরোধ কেবলমাত্র পরিধেয়-র মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। দাক্ষিণাত্যে জৈনধর্ম দাক্ষিণাত্য ছাড়াও কলিঙ্গ, মগধ, মালব, গুজরাট, রাজস্থান প্রভৃতি স্থানেও জৈনধর্ম প্রচারিত হয়। বহির্ভারতে কখনও জৈনধর্ম প্রচারিত হয় নি। যে সব ভারতীয় নৃপতি জৈনধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কলিঙ্গ-রাজ খারবেল, কাথিয়াওয়াড়ের রাজা মণ্ডলিক, গুজরাট-রাজ জয়সিংহ ও কুমারপাল। এছাড়া দাক্ষিণাত্যের চালুক্য, রাষ্ট্রকূট ও গঙ্গ রাজাদের কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।


জৈনধর্মের প্রভাব : জটিল ও ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞকেন্দ্রিক বৈদিক ধর্মাচরণের পরিবর্তে ভারতবাসীকে সহজসরল ধর্মাচরণের পথ দেখিয়েছিল জৈনধর্ম। জৈন ধর্মাচার্যদের বর্ণপ্রথার বিরোধিতা ভারতীয় সমাজে জাতপাতের ব্যবধান কমাতে সাহায্য করেছিল। জৈনধর্মের সততা ও মিতব্যয়িতার আদর্শ এবং সুদের কারবার ও সমুদ্রযাত্রাকে স্বীকৃতিদান ব্যাবসাবাণিজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। সৎ কর্মের মাধ্যমে সব মানুষ মোক্ষ লাভ করতে পারবে— জৈনধর্মের এই শিক্ষা সমাজকে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, মিথ্যাচার প্রভৃতি কুপ্রভাব থেকে মুক্ত করতে পেরেছিল। জৈনধর্মে পশুহত্যার বিরোধিতা করা হলে সমাজে পশুহত্যার পরিমাণ হ্রাস পায়। সেইসময় নির্মিত উদয়গিরি, খণ্ডগিরি, মাউন্ট আবু এবং শ্রবণবেলগোলার জৈন মন্দিরগুলি স্থাপত্যকলার অনুপম নিদর্শন। সংস্কৃত ভাষায় জৈন পণ্ডিত ও সন্ন্যাসীদের রচিত টীকা-ভাষ্যগুলি সংস্কৃত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। জৈন পণ্ডিতদের অর্ধমাগধী ভাষায় ধর্মীয় সাহিত্যচর্চা বহু আঞ্চলিক ভারতীয় ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছিল।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন