মোঘল সম্রাট বাবর

 মোঘল সম্রাট বাবর

ভারতবর্ষে জহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রাজবংশ মোগল বা মুঘল বংশ নামে পরিচিত। ‘মোঙ্গল' কথাটি থেকে মোগল নামের উৎপত্তি হয়েছে।বাবর পিতার দিক থেকে তৈমুর লঙ্ এবং মাতার দিক থেকে চেঙ্গিজ খাঁ-র বংশধর।তুর্কি ভাষায় বাবর কথার অর্থ হল 'সিংহ'।১৪৮৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ওমর শেখ মির্জার মৃত্যুর পর মাত্র বারো বৎসর বয়সে মধ্য এশিয়ার অন্তর্গত ক্ষুদ্র ফারঘনা রাজ্যের সিংহাসনে বসেন। মাত্র চোদ্দো বৎসর বয়সে সমরখন্দ দখল করে এবং কিছুদিন পর সেখান থেকে বিতাড়িত হয়। এর পর তিনি কাবুল দখল করেন।

দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদির সঙ্গে পাঞ্জাবের শাসন- কর্তা দৌলত খাঁ-র বিরোধ দেখা দিলে দৌলত খাঁ ইব্রাহিমকে জব্দ করার জন্য বাবরকে ভারত-আক্রমণের আমন্ত্রণ দেন। বাবর কালবিলম্ব না করে বিশাল বাহিনীসহ ভারত আক্রমণ করেন। দিল্লির সুলতান ইব্রাহিম লোদি বাবরকে বাধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু এই আমন্ত্রণ বাবরের মনপুত হয় নি তাই তিনি কাবুল ফিরে যান। পর  বৎসর১৫২৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি কামান, বন্দুক ও বারো হাজার সৈন্য নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। দৌলত খাঁ লোদিকে পরাজিত করে তিনি পাঞ্জাব দখল করেন এবং দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। দিল্লির কাছে পানিপথের প্রান্তরে দু'পক্ষে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ (২১শে এপ্রিল, ১৫২৬ খ্রিঃ) নামে পরিচিত। বাবরের গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে ইব্রাহিম লোদি পরাজিত ও নিহত হন। এই যুদ্ধের ফলে লোদি বংশের শাসনক্ষমতা চিরতরে অবলুপ্ত হয়, দিল্লি ও আগ্রা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল বাবরের অধিকারে আসে এবং জৌনপুর পর্যন্ত সমৃদ্ধশালী গঙ্গা-যমুনা উপত্যকার দরজা তাঁর কাছে উন্মুক্ত হয়। আগ্রায় বন্দিত ইব্রাহিম লোদির ধনদৌলত বাবরের হস্তগত হওয়ায় তাঁর আর্থিক সংকট কিছুটা দূর হয়।

রানা সঙ্গ বা সংগ্রাম সিংহ সুলতানি সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের উপর রাজপুত সাম্রাজ্য স্থাপনের সংকল্প করেন। মাড়োয়ার, অম্বর, চান্দেরি, গোয়ালিয়র, আজমীর প্রভৃতি রাজ্যের রাজপুত নৃপতিগণ এবং ইব্রাহিম লোদির ভ্রাতা মামুদ লোদি-র সঙ্গে মিলিত হয়ে যুগ্মভাবে তিনি বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই মার্চ খানুয়ার প্রান্তরে সম্মিলিত রাজপুত বাহিনীর বিরুদ্ধে বাবর জয়যুক্ত হন। এর কিছুকাল পরে রানা সঙ্গের মৃত্যু হয়। ভারত ইতিহাসে খানুয়ার যুদ্ধ অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। খানুয়ার যুদ্ধে বাবরের জয়লাভের ফলে মোগলদের রাজনৈতিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু কাবুল থেকে আগ্রায় স্থানান্তরিত হয়।

রানা সংগ্রাম সিংহের মৃত্যুর পর তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর গোয়ালিয়রের চান্দেরি দুর্গের মেদিনী রাই-এর নেতৃত্বে রাজপুতরা সংঘবদ্ধ হচ্ছিল। বাবর মেদিনী রাইকে পরাজিত করে চান্দেরি দুর্গ ও অন্যান্য কিছু অঞ্চল নিজ অধিকারে আনেন।

বাবরের বাহিনী কনৌজ, বারাণসী, এলাহাবাদ দখল করে বিহারের সীমান্তে ঘর্ঘরা নদীর তীরে উপনীত হলে বাংলার নসরৎ শাহ, বিহারের শের খাঁ এবং জৌনপুরের মামুদ লোদি বাবরকে বাধা দেন। ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে পাটনার উত্তরে গঙ্গা ও ঘর্ঘরা নদীর সংগমস্থলে মোগল ও আফগান বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। সুশিক্ষিত মোঘল বাহিনী আফগানদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। ইতিহাসে এই যুদ্ধ ঘর্ঘরা যুদ্ধ নামে খ্যাত। এর ফলে (১) বাবরের এক প্রবল প্রতিপক্ষ শক্তি সাময়িকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, (২) নব-গঠিত মোগল আধিপত্য সুদৃঢ় হয় এবং (৩) কাবুল থেকে গোগরা এবং হিমালয় থেকে গোয়ালিয়র পর্যন্ত ব্যাপক স্থানে মোগল সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়। এই যুদ্ধের এক বৎসর পর ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে ডিসেম্বর সাতচল্লিশ বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়।

ভারতবর্ষে বাবর মাত্র চার বৎসর রাজত্ব করেন এবং এই অল্প সময়ের মধ্যে তিন শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করে তিনি ভারতে একটি নতুন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত করে তাকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর স্থাপন করে যান। ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে স্বীকৃত, তুর্কি ভাষায় রচিত বাবরের স্মৃতিকথা 'তুজুক-ই-বাবরী' বা 'বাবরনামা' এক অসাধারণ সাহিত্য-কীর্তি।


নবীনতর পূর্বতন