বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী
গৌড়ে চৈতন্য
মতাদর্শ
প্রচারিত হয়েছিল শান্তিপুরের অদ্বৈত আচার্যের দ্বারা, ক্রমে শান্তিপুর বৈষ্ণবকেন্দ্রে
পরিণত হয়। নিত্যানন্দের আস্তানা খড়দহও খুব প্রসিদ্ধ বৈষ্ণবকেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁদের তিরোধানের
পরও অদ্বৈতগৃহিণী ও পুত্রেরা শান্তিপুরের খ্যাতি অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন। খড়দহে নিত্যানন্দের
তিরোধানের পর তাঁর কনিষ্ঠা পত্নী জাহ্নবাদেবী এবং পুত্র বীরচন্দ্র (মতান্তরে বীরভদ্র,
ইনি প্রথমা পত্নীর গর্ভজাত) খড়দহের নেতৃত্ব করেছিলেন, জাহ্নবাদেবী বৈষ্ণব-সমাজে বিশেষ
শ্রদ্ধাভক্তি লাভ করেছিলেন।
বৃন্দাবনের কয়েকজন গোস্বামী, যাঁরা সকলেই চৈতন্যদেবের ভক্তশিষ্য
ছিলেন, তাঁরা সংস্কৃতে ও বাংলায় নানা গ্রন্থ রচনা করে চৈতন্যদেবের আবেগের ধর্মকে সুদৃঢ়
দার্শনিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সংস্কৃতে রচিত হওয়াতে এঁদের গ্রন্থগুলি
সর্বভারতীয় বিদ্বজ্জন-সমাজে প্রচার লাভ করেছিল, এই সমস্ত দার্শনিক ও ভক্তিগ্রন্থের
সহায়তায় গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের তত্ত্ববাদ বাংলার বাইরে প্রচারিত হয়েছিল। এঁদের বৃন্দাবনের
ষড়গোস্বামী বলা হয়। সনাতন, রূপ, জীব, গোপালভট্ট, রঘুনাথ দাস, রঘুনাথ ভট্ট—মূলত এঁরাই
বৃন্দাবনের ষড়গোস্বামী নামে পরিচিত। কৃষ্ণদাস কবিরাজকে ধরলে এঁদের সংখ্যা হবে সাত।
কৃষ্ণদাস বাংলায় প্রসিদ্ধ চৈতন্য-জীবনী-কাব্য ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' লিখেছিলেন।
তাঁদের কনিষ্ঠ ভ্রাতার পুত্র সুবিখ্যাত জীবগোস্বামী। ইতিপূর্বে
আমরা বলেছি গৌড়েশ্বর হুসেন
শাহের
উচ্চপদস্থ কর্মচারী সনাতন ও রূপ বাঙালি ছিলেন না, এঁরা ছিলেন দক্ষিণ ভারতীয় কণটি ব্রাহ্মণ,
তবে কয়েক পুরুষ বাংলাদেশে বাস করে বাঙালি হয়ে গিয়েছিলেন। এঁরা গৌড়ের অনতিদূরে বিখ্যাত
রামকেলি গ্রামে (এ গ্রাম এখনও বৈষ্ণব তীর্থরূপে বিরাজমান) বাস করতেন।
সনাতন গোস্বামী—তাঁর রচিত 'বৃহদ্ভাগবতামৃত', 'হরিভক্তিবিলাস’
ও ‘বৈষ্ণবতোষণী' (ভাগবতের টীকা) গ্রন্থ পাওয়া যায়।
রূপ গোস্বামী- সনাতনের ছোটো ভাই রূপগোস্বামী গৌড়েশ্বরের উচ্চ
রাজকর্মচারী (ইনি সুলতানের নিকট ‘দবির খাস’ এই সম্মানজনক উপাধি লাভ করেছিলেন, সনাতনগোস্বামী
‘শাকর মল্লিক' নামে খ্যাত হয়েছিলেন) হলেও মহাপ্রভুর দর্শনলাভের পর জ্যেষ্ঠের আগেই
গৃহত্যাগ করেন এবং প্রয়াগে মহাপ্রভুর কাছে উপস্থিত হন।
তাঁর ‘হংসদূত’ ও ‘উদ্ধব-সন্দেশ" কাব্য দু'খানি বৈষ্ণবসাহিত্যে
সুপরিচিত।
নাটকের মধ্যে ‘বিদগ্ধমাধব’
ও ‘ললিতমাধব' অতি বিখ্যাত। তিনি ‘পদ্যাবলী' নামে যে পদসংকলন গ্রন্থ এধিত করেছিলেন,
বৈষ্ণব-সংকলন হিসেবে তার মূল্য অবশ্য স্বীকার্য। নাটকচন্দ্রিকা'য় তিনি নাট্যতত্ত্ব
আলোচনা করেছিলেন।
তাঁর মনীষা বিশেষভাবে
প্রকাশ পেয়েছে 'ভক্তিরসামৃতসিন্ধু' ও 'উজ্জ্বলনীলমণি'-তে।
জীব গোস্বামী- সনাতন রূপের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা অনুপম বা
বল্লভের পুত্র জীব।
তাঁর নামে অনেকগুলি
কাব্য (গোপাল চম্পু, সংকল্পকল্পদ্রুম, মাধবমহোৎসব ইত্যাদি), ব্যাকরণ ও রসশাস্ত্র
(হরিনামামৃত ব্যাকরণ, সূত্রমালিকা, রসামৃতশেষ প্রভৃতি) বৈষ্ণবস্মৃতি ও ধর্মতত্ত্ব
(গোপালতাপনী, ব্রহ্মসংহিতা, লঘুতোষণী), এবং প্রসিদ্ধ বৈষ্ণব দার্শনিক গ্রন্থ ষট্সন্দর্ভ
(তৎসন্দর্ভ, ভগবৎসন্দর্ভ, পরমাত্মসন্দর্ভ, শ্রীকৃষ্ণসন্দর্ভ, ভক্তিসম্পর্ভ,
প্রীতিসন্দর্ভ) পাওয়া যায়।