কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩)



১৮২৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ জানুয়ারি বর্তমান বাংলাদেশের যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে মধুসূদন জন্মগ্রহণ করেন। ফরাসী ভাষায় দক্ষতার জন্য 'মুন্সী রাজনারায়ণ" নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। মাতা জাহ্নবী ছিলেন নিষ্ঠাবান কায়স্থ বধূ।১৮৪৩ সালে বিলেত যাবার জন্য ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলেন। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার জন্য হিন্দু কলেজ ছাড়তে বাধ্য হলেন, ভর্তি হলেন শিবপুরের বিশপস্ কলেজে। ধর্মান্তরিত হবার পর তাঁর নামের আগে 'মাইকেল' শব্দ যুক্ত হল।

মধুসূদনের কাব্য : ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে দু'টি ইংরেজি কাব্য প্রকাশিত হয়—"The Captive Ladie', 'Visions of the Past'। বাংলা কাব্যগ্রন্থগুলো হল—'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' (১৮৬০), 'মেঘনাদবধ কাব্য' (১৮৬১), 'ব্রজাঙ্গনা কাব্য' (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা কাব্য' (১৮৬২), 'চতুদর্শপদী কবিতাবলী' (১৮৬৬), 'হেক্টরবধ' (১৮৭১)। বাংলা সাহিত্যের প্রথম গীতিকবিতা 'আত্মবিলাপ' (১৮৬১)।

প্রথমে মধুসূদন দত্তের কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ ইংরেজি কবিতায়। ১৮৪৮-৪৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে মাদ্রাজ থেকে ‘Madras Circulator' পত্রিকায় তিনি ‘Timothy Penpoem' ছদ্মনামে "The Captive Ladie' এবং 'Visions of the Past' শীর্ষক দুটি ইংরেজি কাব্যে পৃথ্বীরাজ সংযুক্তার কাহিনি বর্ণনা করেন। ১৮৪৯ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।

 'তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য' ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। মাইকেলের উদ্ভাবিত নূতন অমিত্রাক্ষরছন্দে এই কাব্য রচিত হয়েছে।এই কাব্যের প্রথম দুই সর্গ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের 'বিবিধার্থ সংগ্রহ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৮৬০-এর মে মাসে। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের প্রেরণায় এই কাব্য সৃষ্টি বলে তাঁকেই এই গ্রন্থ উৎসর্গ করেন।সংস্কৃত পুরাণ ও মহাভারতের আদি পর্বের কাহিনি অবলম্বনে চার সর্গে মধুসূদন ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ রচনা করেন।

মেঘনাদবধ কাব্য (১৮৬১): মেঘনাদবধ কাব্য বাংলা মহাকাব্য ধারার প্রথম ও প্রধান সৃষ্টি। এই কাব্যের কাহিনী তিন দিন দুই রাত্রি। এই কাব্যটি নয়টি সর্গে বিভক্ত। সর্গ গুলি হল — অভিষেক, অস্ত্রলাভ, সমাগম, অশোকবন, উদ্যোগ, বধ, শক্তিনির্ভেদ, প্রেতপুরী, সংস্ক্রিয়া।

ব্রজাঙ্গনা: মধুসুদনের 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। 'মেঘনাদবধ' কাব্য রচনার আগে (১৮৬০) তিনি এই কাব্য রচনা করেছিলেন। প্রথমে কাব্যটির নাম ছিল ‘রাধাবিরহ'। বাংলায় প্রথম 'ওড' কাব্য। 'ব্রজাঙ্গনা' কাব্যের মূল কথা প্রেম এবং মূল উপকরণ প্রকৃতি। প্রকৃতি সম্পর্কে রোমান্টিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় রয়েছে এই কাব্যে। এই কাব্যের মোট আঠারটি কবিতার মধ্যে বারোটি প্রকৃতি বিষয়ক। ঋতু বিষয়ক কবিতা হল জলধর, মলয়-মারুত, বসন্তে। কাল বিষয়ক কবিতা হল—ঊষা, গোধূলি। স্থান বিষয়ক কবিতা—যমুনাতটে, নিকুঞ্জবনে। ফুল বিষয়ক কবিতা–কুসুম, কৃষ্ণচূড়া এবং পাখি বিষয়ক কবিতা হল– ময়ূর, সারিকা।

বীরাঙ্গনা কাব্য (১৮৬২): ‘বীরাঙ্গনা কাব্য' বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সার্থক পত্রকাব্য। গ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা মূলত নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যকে প্রকাশ করার জন্য। কারণ বইটি উৎসর্গ করেছেন ‘বঙ্গকুলচূড়’ বিদ্যাসাগরকে যিনি নারীমুক্তির ও নারীজাগৃতির বাণী পরোক্ষে প্রচার করেছেন। একদিকে নারীমুক্তির প্রেরণা। রোমান কবি ওভিদের 'Heroides'-এর অনুসরণে ‘বীরাঙ্গনা' কাব্যের প্রকাশ। এখানে মোটে এগারোটি পত্র আছে, পত্রগুলি হল— ‘দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা', 'দশরথের প্রতি কৈকেয়ী', ‘লক্ষ্মণের প্রতি সূর্পনখা', 'অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী', 'দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী', 'জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা, ‘শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী', 'পুরুরবার প্রতি উর্বশী' এবং 'নীলধ্বজের প্রতি জনা' প্রভৃতি। বীরাঙ্গনার পত্রের শ্রেণিবিভাগ— প্রেমপত্র (সোমের প্রতি তারা), প্রত্যাখ্যান পত্র (শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী), অভিযোগ পত্র (দশরথের প্রতি কৈকেয়ী) এবং প্রোষিতভর্তৃকা পত্নীর পত্র (দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা)।

চতুর্দশপদী কবিতাবলী: মধুসূদনের প্রবাস জীবনের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম ‘চতুর্দশপদী কবিতা’ রচনা। বাংলা ভাষায় চতুর্দশপদী কবিতার জন্ম মধুসূদনের হাতে। পাশ্চাত্য সনেটের আদর্শে লেখা ১০২টি সনেটের সংকলন গ্রন্থ হল 'চতুর্দশপদী কবিতাবলী'। বিভিন্ন ধরনের সনেট এখানে আছে। যেমন—জয়দেব, বিদ্যাসাগর, বঙ্গভাষা, কল্পনা, কবি, কপোতাক্ষ নদ, অন্নপূর্ণার ঝাঁপি, শ্রীপঞ্চমী ইত্যাদি। ১৪ চরণে ৮+৬ মাত্রায় একটি নির্দিষ্ট মিল বিন্যাসকে অনুসরণ করে এই সনেটগুলো রচনা করেন। সনেট গুলি পেত্রার্ক, শেক্সপীরীয় রীতিতে, কোনোটি আবার মধুকবি নিজস্ব রীতিতে লিখেছেন।

বাংলা কাব্য সাহিত্যে মধুসূদনের অবদান: মধুসূদনের কাব্য প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এর সমন্বয় সাধন ঘটেছে। বাংলা কাব্য সাহিত্যের প্রথম গীতিকবিতা 'আত্মবিলাপ' তিনি রচনা করেন। বাংলা সাহিত্যে প্রথম সাহিত্যিক মহাকাব্য (মেঘনাদবধ কাব্য), পত্রকাব্য (বীরাঙ্গনা), সনেট রচনা করেছেন। বাংলা কাব্যে ছন্দের ক্ষেত্রে পয়ারের বেড়ি ভেঙে সৃষ্টি করেন অমিত্রাক্ষর ছন্দ। প্রথম 'তিলোত্তমা কাব্য' অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচনা করেন। মধুসূদনের কাব্য রয়েছে পরিচ্ছন্ন ও সাবলীল  বাক্-রীতির প্রয়োগ, চিত্রকল্প ও অলংকারের প্রয়োগ। তাঁর কাব্যের ভাষারীতির পরিছন্নতা বাংলা কাব্যকে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে।

নবীনতর পূর্বতন