মালাধর বসু

মালাধর বসু



কবি পরিচয়: মালাধর বসু তাঁর কাব্যের আদিতে এবং অন্তে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু আত্ম পরিচয় দিয়েছেন। কবির সম্ভাব্য জন্ম সাল ১৪২২ খ্রিস্টাব্দের আশেপাশে।

                        ‘বাপ ভগিরথ মোর মা ইন্দুমতী।
                        জার পুর্ণ্যে হৈল মোর নারাঅনে মতি।।’


কবির পিতার নাম ভগিরথ, মাতার নাম ইন্দুমতী। এরা বৈষ্ণব ছিলেন। আদিশূর যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ এবং পাঁচজন কায়স্থকে বাংলাদেশে এনেছিলেন। সেই পাঁচজন কায়স্থের অন্যতম ছিলেন দশরথ। তাঁর ত্রয়োদশ পুরুষ হলেন মালাধর বসু। মাতা পিতার পূণ্যফলে মালাধর বসুর অন্তরে কৃষ্ণ ভক্তি সঞ্চারিত হয় এবং তিনি শ্রীকৃষ্ণবিজয় রচনা আত্মনিয়োগ করেন। কুলীন গ্রামের কায়স্থ কুলে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ব্যাসদেবের স্বপ্নাদেশে কবি কাব্যরচনা করেন। গৌড়েশ্বর রুকনুদ্দিন বরবক শাহ কবিকে ‘গুনরাজ খান’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কবির পুত্রের নাম সত্যরাজ খান। মালাধরের পৌত্র রামানন্দ মহাপ্রভুর সেবক ছিলেন। চৈতন্যচরিতামৃতের বর্ণনা থেকে জানা যায় চৈতন্যদেব মালাধর বসুকে গুনরাজ খান রূপে অভিহিত করেছেন। জয়ানন্দও চৈতন্যমঙ্গলে কবিকে ‘গুনোরাজ ছত্রী’ উল্লেখ করেন। চৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণ করার পর কুলীন গ্রামে উপস্থিত হলে সেখানে যে মহোৎসব হয়েছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন।

কাব্যের রচনাকাল: রাধিকানা দত্ত ও কেদারনাথ দত্ত ১৮৮৬-৮৭ খ্রিস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের যে সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন তা শেষ দিকে এমন কতগুলি পদ পাওয়া যায় যেগুলি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এর মধ্যে একটি পদে শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের রচনা কাল দেওয়া আছে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত নন্দলাল বিদ্যাসাগর সম্পাদিত শ্রীকৃষ্ণবিজয় গ্রন্থের শেষ দিকে ওই পদটি পাওয়া যায়। পদটি থেকে জানা যায় ১৩৯৫ শক বা ১৪৭৩-৭৪ খ্রিস্টাব্দে শ্রীকৃষ্ণবিজয়ের রচনা শুরু হয় এবং ১৪০২ শক ১৪৮০-৮১ খ্রিস্টাব্দে রচনা শেষ হয়। পদটি এই-
                      ‘তেরশ পচাঁনই শকে গ্রন্থ আরম্ভন।
                       চতুর্দ্দশ দুই শকে হৈলো সমাপন।।’


মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় গ্রন্থটির একাধিক নাম রয়েছে-গোবিন্দবিজয়, গোবিন্দমঙ্গল, শ্রীকৃষ্ণবিক্রম। ‘বিজয়’ শব্দের অন্যান্য অর্থ-বিক্রমরচিত, গমন, আগমন ও যাত্রা।

চৈতন্য পূর্ববর্তী কালে গুনরাজ খান ভাগবতের দশম ও একাদশ স্কন্ধের অনুবাদ করে শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্য রচনা করেন। এই অনুবাদ আক্ষরিক অনুবাদ নয়। কবি কাব্যের প্রথম দিকে স্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ করেছেন, পণ্ডিতের মুখে ভাগবত এর বর্ণনা শুনে ওই গ্রন্থের অর্থ পয়ার ছন্দে বর্ণনা করেছেন। বাংলায় পয়ার শব্দে সর্ব প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যে। সেই কারণেই স্বচ্ছন্দে বলা যায়, কৃত্তিবাসের রামায়ণ এবং কাশীরাম দাসের মহাভারতের মত শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যও শ্রীমদভাগবতের ভাবানুবাদ। শ্রীকৃষ্ণবিজয় ভাগবতের অনুবাদ আশ্রয়ী কাব্য। শ্রীকৃষ্ণবিজয় গেয় কাব্য। জনগণের আসরে সংগীতের মধ্য দিয়ে এই কাব্য পরিবেশিত হত। পুঁথিতে সর্বত্রই রাগের উল্লেখ আছে। গীতিকা কাব্যে যেমন আখ্যানমূলক গীত রচিত হয় শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যেও তাই। গুনরাজ খান নিজের তার কাব্যটি পাঁচালীর রূপে উল্লেখ করেছেন। সংস্কৃত পাঞ্চালি শব্দ থেকে পাঁচালী শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে। পাঞ্চালি কাব্য দুই রকমের-নাটগীতি ও আখ্যায়িকা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নাটগীতি আর শ্রীকৃষ্ণবিজয় আখ্যায়িকা।

 মালাধর বসু ভাগবতের দশম স্কন্ধের কৃষ্ণের জন্ম থেকে দ্বারোকা লীলা পর্যন্ত বর্ণনা করেছেন এবং একাদশ স্কন্ধের কৃষ্ণ-উদ্ধবের আত্মযোগ কথন, যদুবংশ ধ্বংস এবং কৃষ্ণের তনু ত্যাগের কাহিনীটুকু গ্রহণ করেছেন। এছাড়া তিনি বিষ্ণুপুরাণ ও হরিবংশপুরাণের কিছু কিছু কাহিনী এখানে অনুসৃত হয়েছে। এছাড়া বৃন্দাবনলীলা, রাধাকৃষ্ণের রাস, নৌকালীলা, দানলীলা ভাগবত বহির্ভূত।
ভাগবতের অন্যান্য অনুবাদক: যশোরাজ খান -কৃষ্ণমঙ্গল, দৈবকিনন্দন সিংহ -গোপাল বিজয়, রঘুনাথ ভাগবতাচার্য -কৃষ্ণপ্রেমতরঙ্গিনী,
জমাধব -শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল, দুঃখী শ্যামদাস -গোবিন্দমঙ্গল, কৃষ্ণদাস -কৃষ্ণমঙ্গল, পরশুরাম চক্রবর্তী -শ্রীকৃষ্ণমঙ্গল, পরশুরাম রায়- মাধবসংগীত।

নবীনতর পূর্বতন