চণ্ডীমঙ্গলের কাহিনী
আখেটিক খণ্ড:
সংস্কৃত আক্ষেটিক
থেকে আখেটিক কথাটি প্রচলিত। শব্দটির অর্থ ব্যাধ বা শিকারি। মর্তের মানুষের কাছ থেকে
পূজা আদায় করে নেওয়ার বাসনায় দেবী চণ্ডী মায়ার সাহায্য নিলেন। শিবপূজার ফুল স্বর্গরাজ্যে
না পেয়ে ইন্দ্রপুত্র নীলাম্বর পৃথিবীতে পাড়ি দিলেন। পৃথিবীতে এসে ব্যাধ-জীবনের ছবি
লক্ষ করে নীলাম্বরের মনে ব্যাধ হওয়ার অভিলাষ জন্মাল। যাইহোক, ফুল চয়ন করে তিনি যথাস্থানে
নিয়ে গেলেন এবং দেবী চণ্ডী ছোট্ট কীট সেজে সেই পুষ্পরাশির মাঝে লুকিয়ে রইলেন। কার্যক্ষেত্রে
কীট মহাদেবকে দংশন করল। তার সবটুকু দোষ গিয়ে পড়ল নীলাম্বরের ঘাড়ে। মহাদেবের অভিশাপের
প্রভাবে তিনি পৃথিবীতে ধর্মকেতু ব্যাধের পুত্র কালকেতু হয়ে জন্মগ্রহণ করলেন। নীলাম্বর-পত্নী
ছায়া হলেন সঞ্জয়কেতুর মেয়ে ফুল্লরা।
কালকেতু ছোটো
থেকেই মহাপরাক্রমশালী। যৌবনে সে বীর শিকারি হয়ে উঠল। তার বিবাহ হল ফুল্লরার সঙ্গে।
কিন্তু নবদম্পতির সংসারে অভাব-অনটনের শেষ নেই। কোনোক্রমে কায়ক্লেশে তাদের দিন গুজরান
হয়। কালকেতু বনে পশুশিকার করে। অতঃপর সেই মাংস বাজারে বিক্রি করে নিজেদের অন্নবস্ত্রের
সংস্থান করে।
ওদিকে কালকেতুর
বিক্রমে বনের পশুরা অতিষ্ঠ হয়ে চণ্ডীদেবীর কাছে আকুল প্রার্থনা জানাল। দেবী তাদের নিশ্চিন্ত
করলেন। পরদিন শিকারে বেরিয়ে চণ্ডীর মায়ার প্রভাবে কালকেতু কোনো শিকারই হস্তগত করতে
পারল না। শুধু এক স্বর্ণগোধিকা ছাড়া। অবশেষে ক্রুদ্ধ, বিরক্ত কালকেতু সেই স্বর্ণগোধিকাটিকে
ধনুকের গুণে বেঁধে বাড়ি নিয়ে এল। সংসারে সেদিন সবকিছুই বাড়ন্ত। কালকেতুর পরামর্শে ফুল্লরা
সাহায্যের আশায় প্রতিবেশীর কাছে গেল আর নিরুপায় কালকেতু বাসি মাংসের পসরা সাজিয়ে বাজারের
উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
বলা বাহুল্য,
স্বর্ণগোধিকাটি স্বয়ং দেবী চণ্ডী। বাড়িতে স্বামী-স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে তিনি সুন্দরী
যুবতির রূপ পরিগ্রহ করলেন। ফুল্লরা ফিরে এসে তাঁকে প্রত্যক্ষ করে যথারীতি বিস্মিত হয়ে
গেল। পরিচয় জানতে চাইলে সুন্দরী বলল যে কালকেতু তাকে 'নিজগুণে বেঁধে' ঘরে নিয়ে এসেছে।
এখন থেকে তাই সে কালকেতুর ঘরেই থাকবে। শুনে ফুল্লরার বুক কেঁপে উঠল। কেননা শত অভাব-অনটনের
মধ্যে স্বামীপ্রেমই ছিল তার শেষ ভরসার বস্তু। সতীনের আবির্ভাবে সেই সুখের দিনেরও বোধ
হয় অবসান ঘটল-এই ভেবে ফুল্লরা বিশেষ কাতর হল। সুন্দরীকে অনেক নীতি-উপদেশ শুনিয়ে, নিজের
বারোমাসের দুঃখান্তক জীবনকথা বিবৃত করে নিবৃত্ত করতে চাইল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল
না। তখন সে মনের দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে কালকেতুর সন্ধানে প্রবৃত্ত হল এবং পথে কালকেতুকে
দেখতে পেয়ে বিস্তর গঞ্জনা ও গালি বর্ষণ করল। অভিমানে বলে উঠল-
“পিঁপীড়ার
পাখা উঠে মরিবার তরে।
কাহার ষোড়শী কন্যা আনিয়াছ ঘরে।।”
কালকেতুও অবাক।
সব কিছু ভালো করে বুঝতে সে ঘরে উপস্থিত হল। সুন্দরীকে মিষ্টি বচনে ঘর থেকে বিতাড়িত
করতে না পেরে শেষে কালকেতু ধনুকে শর জুড়ল। কিন্তু সেই শর নিক্ষিপ্ত হল না। স্বামী-স্ত্রীর
ভয়-আশঙ্কা-বিস্ময় যখন উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে তখন দেবী আত্মপ্রকাশ করলেন। সবিস্তারে
সকল ঘটনা জানিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ ফুল্লরা- কালকেতুকে অনেক ধনরত্ন উপহার দিলেন। আদেশ দিলেন
বন কেটে গুজরাট নগরী পত্তন করতে।
কালকেতু গুজরাট
নগরীর রাজা হল। সেখানে ভাঁড়ু দত্ত নামক এক প্রবঞ্চক বসবাস করত। সে কালকেতুর সঙ্গে
স্বার্থের সম্পর্ক তৈরি না করতে পেরে চক্রান্ডের আয়োজন করল। কালকেতুর বিরুদ্ধে কলিঙ্গরাজকে
খেপিয়ে তুলল। বেধে গেল যুদ্ধ। যুদ্ধে কালকেতু পরাস্ত ও বন্দি হল। তারপর সে দেবী চণ্ডীর
স্তব করতে শুরু করলে-তিনি কালকেতুকে ছেড়ে দিতে কলিঙ্গরাজকে স্বপ্নাদেশ দিলেন। রাজ্য
এবং নিজের স্বাধীনতা কালকেতু পুনরায় ফিরে পেল। কিন্তু ভাঁড়ু দত্তকে ক্ষমা করল না।
তার মুখে চুনকালি মাখিয়ে, মাথা মুড়িয়ে তাকে দেশছাড়া করল।
দেবীর কৃপায় বেশ
কিছুদিন সুখে-শান্তিতে রাজ্যশাসন করার পর কালকেতু পুত্রের হাতে সমস্ত দায়দায়িত্ব অর্পণ
করে স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করল।
বণিক খণ্ড:
উজানী নগরে ধনপতি
নামে এক বিলাসী সদাগর বসবাস করত। একদিন পায়রা ওড়াতে গিয়ে তার দৃষ্টি শ্যালিকা খুল্লনার
প্রতি নিবদ্ধ হয়। রূপমুগ্ধ ধনপতি তাকে বিবাহ করতে চাইলে বড়ো বউ লহনা অসন্তুষ্ট হলেন।
বহু কষ্টে বেশ কিছু প্রসাধন- সামগ্রী ও সোনা-দানা উৎকোচ দিয়ে ধনপতি লহনাকে রাজি করাল।
বিয়ের পর রাজাজ্ঞায়
ধনপতি সোনার খাঁচা আনতে গৌড় চলে গেলেন। আর খুল্লনার ভার অর্পিত হল লহনার হাতে। উভয়ের
পারস্পরিক স্নেহ-ভালোবাসা দেখে দাসী দুর্বলার হিংসা হল। তাদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি
করার বাসনায় সে লহনাকে খুল্লনার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করল। লহনাও সেই ফাঁদে পা দিল। নানা
ধরনের তুকতাক পর্বশেষ হলে, একদিন লহনা ধনপতির জাল চিঠির সাহায্য নিয়ে খুল্লনাকে একবেলা
খেতে, ঢেঁকিশালে শুতে এবং ছাগল চরাতে বাধ্য করল। বেচারি খুল্লনা কী আর করবে। সেও সেইসব
বিধান মেনে নিল। আধপেটা খেয়ে, ছাগল চরিয়ে তার দিন কাটে। তারপর একদিন দৈবক্রমে, বনের
মধ্যে হঠাৎ পাঁচ দেবকন্যাকে চন্ডীপূজায় নিয়োজিত দেখতে পায়। তাদের কল্যাণে চন্ডীপূজার
বিধি আয়ত্ত করে নিয়ে সে চণ্ডীর আরাধনা করে। দেবী চণ্ডী স্তুতিতে সন্তুষ্ট হয়ে তাকে
স্বামী-পুত্র লাভের বর দান করলেন।
দেবীর কৃপাতেই
ধনপতির বাড়ির কথা মনে পড়ে। সে ফিরে আসে। দিন কাটতে থাকে বিনা বাধায়। কিন্তু ধনপতির
পিতৃশ্রাদ্ধের দিন গণ্ডগোল দেখা যায়। নিমন্ত্রিত অতিথিরা খুল্লনার সতীত্বে সন্দেহ করেন।
ধনপতি জরিমানার বিনিময়ে সেই অভিযোগ খণ্ডিত করতে চাইলেও, খুল্লনা নারীত্বের পরীক্ষা
দিতেই মনস্থির করে। খুল্লনা সব পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ হল। তবে বিপদ কেটে গেলেও
নিরবচ্ছিন্ন শান্তি খুল্লনার ভাগ্যে নেই।
রাজার আদেশে ধনপতি
এবার সুদূর সিংহল দেশ থেকে চন্দন আনতে গেল। যাত্রাকালে দেবী চণ্ডীকে অবজ্ঞা করায় দেখা
গেল যে একটি বাদে তার সব ডিঙাই জলে ডুবে গেছে। উপরন্তু দেবী চণ্ডী তাকে কমলে-কামিনী
মূর্তি দেখালেন।
সিংহলরাজের কাছে
গিয়ে ধনপতি সেই কথা পাড়ল। রাজা বিশ্বাস করলেন না। কথা দিলেন যে যদি ধনপতি সেই দৃশ্য
দেখাতে পারে তাহলে অর্ধেক রাজত্ব দেবেন। কিন্তু ব্যর্থ হলে সারা জীবনের জন্য বন্দিত্ব
বরণ করে নিতে হবে।
দেবীর ছলনায় শর্ত
রাখতে ব্যর্থ হল ধনপতি। অঙ্গীকার অনুসারে তার জীবনে কারাবাস নেমে এল। উজানীনগরে ওদিকে
খুল্লনার পুত্র হয়েছে। নাম শ্রীমন্ড। পিতৃপরিচয় নিয়ে একদিন কটাক্ষ করায় সে পিতাকে খুঁজে
বের করতে বদ্ধপরিকর হল। মায়ের চোখের জলকে উপেক্ষা করে শ্রীমন্ত সিংহল রওনা দিল। এবং
পথিমধ্যে শ্রীমন্তও কমলে- কামিনী প্রত্যক্ষ করল। রাজদরবারের গিয়ে সেই গল্প করলে রাজা
তা এবারও বিশ্বাস করলেন না। অর্ধেক রাজত্ব ও রাজকন্যার শর্তে শ্রীমন্ত রাজাকে সেই অত্যাশ্চর্য
ঘটনা দেখাতে প্রতিশ্রুত হল। কিন্তু দেবী ছলনা করলেন আবারও। উপরন্তু ব্যর্থ হওয়ার ফলস্বরূপ
রাজা তার শিরশ্ছেদের বিধান দিলেন।
আসন্ন কালে চন্ডীসেবক
শ্রীমন্ড দেবীর স্তব শুরু করল। শ্রীমন্তকে কৃপা করলেন তিনি। সিংহলরাজকেও কমলে কামিনী রূপ দেখালেন।
এবং তাঁর সহৃদয়তায় শ্রীমন্ত ও ধনপতির সঙ্গে রাজার বিরোধ মিটে গেল। ধনপতি মুক্তি পেলেন।
মিলিত হলেন পিতাপুত্র। শর্ত মোতাবেক সিংহল রাজকন্যা সুশীলার সঙ্গে শ্রীমন্ডের আগেই
বিবাহ হয়েছিল। দেশে ফিরে উজানীনগরের রাজাকেও শ্রীমন্ড কমলে-কামিনী দেখাতে পারায় তাঁর
কন্যা জয়াবতীকেও লাভ করল এবং মহা আড়ম্বরে ধনপতি দেবী চণ্ডীর আরাধনায় রত হল।