গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বৌদ্ধধর্ম

 গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বৌদ্ধধর্ম

বুদ্ধের জীবনী: আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৬ অব্দে কপিলাবস্তু নগরের কাছে 'লুম্বিনী' উদ্যানে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধের জন্ম হয়। তাঁর পিতা শুদ্ধোধন ছিলেন ক্ষত্রিয় শাক্য-জাতির রাজা। তাঁর মাতার নাম মায়াদেবী। বুদ্ধের বাল্য নাম সিদ্ধার্থ। বাল্যকালেই তাঁর মা মারা গেলে বিমাতা ও মাতৃম্বসা গৌতমী তাঁকে লালনপালন করেন। তাই তাঁর আর-এক নাম গৌতম। মাত্র ষোলো বছর বয়সে গোপা বা যশোধরা নামে এক রাজকন্যার সঙ্গে গৌতমের বিবাহ হয়।
বাল্যকাল থেকে সংসারের ভোগবিলাসের প্রতি গৌতম উদাসীন ছিলেন। মানব-জীবনের দুঃখ-যন্ত্রণা নিয়তই তাঁকে পীড়া দিতে থাকে এবং কীভাবে মুক্তি পাওয়া যায় সেই চিন্তাতেই ব্যাকুল ছিলেন। অবশেষে ২৯ বছর বয়সে যেদিন তাঁর পুত্র রাহুলের জন্ম হয়, সেদিনই রাত্রে তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেন। বৌদ্ধগ্রন্থে তাঁর গৃহত্যাগের ঘটনা মহাভিনিষ্ক্রমণ নামে খ্যাত।

বুদ্ধত্ব বা বোধিসত্ত্ব লাভ: গৃহত্যাগের পর গৌতম আলারা কালামা নামে এক ঋষির শিষ্যত্ব নেন। তাঁর কাছে ধ্যানের পদ্ধতি ও উপনিষদের ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষালাভ করেন। কিন্তু দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভের সঠিক পথ সম্বন্ধে তাঁর জিজ্ঞাসা তখনও অপূর্ণ থেকে যায়। তাই ওই ঋষির সঙ্গ ত্যাগ করে গৌতম পাঁচজন তপস্বীর সঙ্গে যোগ দেন। এঁদের সঙ্গে তিনি কঠোর কৃষ্ণসাধনে রত হন। ক্রমে তিনি একটি চলমান কঙ্কালে পরিণত হন। কিন্তু তবুও প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন। তিনি বুঝতে পারেন যে, কেবল শরীরকে কষ্ট দিয়ে প্রকৃত সত্য উপলখি সম্ভব নয়। অতঃপর তপস্বীদের সঙ্গ ত্যাগ করে বর্তমান বুদ্ধগয়ার কাছে উরুবিল্ব নামক স্থানে এক অশ্বত্থ বৃক্ষের তলায় গভীর ধ্যানে মগ্ন হন। একাসনে যোগারূঢ় অবস্থায় ৪৯ দিন থাকার পর তিনি বোধি বা দিব্যজ্ঞান লাভ করেন। এই সময় থেকে তিনি বুদ্ধ (জ্ঞানী) এবং তথাগত (যিনি সত্যের সন্ধান পেয়েছেন) নামে পরিচিত হন। যে স্থানে তিনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন তার নাম হয় 'বোধগয়া’ বা ‘বুদ্ধগয়া’ এবং যে বৃক্ষটির নীচে ধ্যানরত হয়ে তিনি বুঝত্ব অর্জন করেন তার নাম হয় 'বোধদ্রুম’ বা ‘বোধিবৃক্ষ'।


গৌতমবুদ্ধের ধর্মমত:
বুদ্ধত্ব লাভ করার পর বুদ্ধ বারাণসীর কাছে সারনাথে পঞ্চভিক্ষু অর্থাৎ পাঁচজন শিষ্যের কাছে তিনি তাঁর ধর্মমত বিতরণ করেন। এই ঘটনা ধর্মচক্র প্রবর্তন নামে খ্যাত। এরপর ৪৫ বছর ধরে তিনি কাশী, কোশল, মগধ প্রভৃতি স্থানে ধর্মপ্রচার করেন। মগধরাজ বিম্বিসার, অজাতশত্রু, কোশলরাজ প্রসেনজিৎ-সহ বহু পুরুষ ও নারী তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। অবশেষে প্রায় ৮০ বছর বয়সে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের গোরক্ষপুর জেলার কুশীনগরে বুদ্ধদেব দেহত্যাগ করেন (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ অব্দ)। একদিন বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে লুম্বিনী উদ্যানে যে মহাজীবনের সূচনা হয়েছিল, ৮০ বছর পর আরেক বৈশাখী পূর্ণিমা ঔ তিথিতে তার অবসান ঘটল। এই ঘটনা ‘মহাপরিনির্বাণ' নামে খ্যাত।


আর্যসত্য: বুদ্ধ সহজ ও সরল ভাষায় তাঁর ধর্মমত প্রচার করেন। বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য হল সত্যকে উপলব্ধি করা। বুদ্ধ বলেছেন, সমুদ্রের যেমন একটি মাত্র স্বাদ অর্থাৎ লবণ, আমার ধর্মেরও তেমনি একটিমাত্র লক্ষ্য এবং তা হল দুঃখের হাত থেকে মানুষকে মুক্ত করা। বুদ্ধের মতে, মৃত্যুর পর আত্মা পুনরায় নতুন দেহে জন্মলাভ করে। জন্মলাভ করে জীবকে কর্ম করতে হয়। কর্ম থেকে আসে ‘আসত্তি'। আসত্তি নিয়ে আসে 'দুঃখ'। পুনর্জন্ম গ্রহণ করে সেই দুঃখ ভোগ করতে হয়। কর্মফলজনিত পুনর্জন্ম রদ করে দুঃখের হাত থেকে মুক্তিলাভের একমাত্র পথ হল কামনা, বাসনা ও আসক্তি ইত্যাদি দূর করা। এজন্য বুদ্ধদেব মানুষকে চারটি 'আর্যসত্য' উপলব্ধি করার পরামর্শ দিয়েছেন। চারটি আর্যসত্য হল – (i) জগৎ দুঃখময়, (ii) কামনা বাসনা ও আসক্তি থেকেই দুঃখের সৃষ্টি হয়, (iii) দুঃখের কারণ গুলি ধ্বংস করে দুঃখের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এবং (iv) এই কারণগুলির ধ্বংসের উপায় আছে। 


অষ্টাঙ্গিক মার্গ: মানুষকে আসক্তিমুক্ত হয়ে নির্বাণলাভের জন্য বুদ্ধ আটটি পথ বা অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে বলেছেন। এই আটটি পথ হল–সং বাক্য, সৎ-কর্ম, সৎ-সংকল্প, সং-চেষ্টা, সৎ-জীবিকা, সং-চিন্তা, সৎ-চেতনা ও সৎ-সমাধি।

বুদ্ধের মতে, চরম ভোগবিলাস ও চরম কৃচ্ছ্রসাধন, এই দুই পন্থাই আত্মার উন্নতিতে বিঘ্ন ঘটায়। তাই এই দুটি চরম পন্থা পরিত্যাগ করে মানুষকে যে মধ্যপন্থা অনুসরণের নির্দেশ তিনি দিয়েছেন তাকে 'মঝ্ঝিম পন্থা' বা 'মধ্যপন্থা' বলা হয়।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ ও মধ্যপন্থা ছাড়াও বৌদ্ধধর্মে কয়েকটি নৈতিক উপদেশও দেওয়া হয়েছে, সেগুলি হল— (1) পঞ্চশীল অর্থাৎ অহিংসা, পরধন আত্মসাৎ না করা, ব্যভিচারী না হওয়া, মদ্যপান থেকে বিরত থাকা, মিথ্যা না বলা। (ii) সমাধি অর্থাৎ মনঃসংযোগ এবং (iii) প্রজ্ঞা অর্থাৎ অন্তদৃষ্টি।

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ: বুদ্ধের জীবদ্দশায় তাঁর কোন বাণী লিপিবদ্ধ হয় নি। তাঁর নির্বাণ লাভের কয়েক সপ্তাহ পর মগধ রাজ অজাতশত্রুর উদ্যোগে বুদ্ধদেবের শিষ্যরা মগধের রাজধানী রাজগৃহ সম্মেলনে (বৌদ্ধ সংগীতি) মিলিত হয়ে তাঁর উপদেশাবলী পুস্তক আকারে প্রকাশ করেন। পালি ভাষায় রচিত এই ধর্মগ্রন্থের নাম 'ত্রিপিটক'। 'পিটক'কথার অর্থ পাত্র বা ঝুড়ি।বৌদ্ধ শাস্ত্রের তিনটি ভাগ—তাই ত্রিপিটক। ত্রিপিটক হল : সূত্ত-পিটক, বিনয়-পিটক ও অভিধর্ম-পিটক। সূত্ত-পিটকে বুদ্ধের উপদেশাবলী, বিনয়-পিটকে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের পালনীয় বিধিসমূহ ও সঙ্ঘের নিয়মাবলী এবং অভিধর্ম-পিটকে বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক তত্ত্বসমূহ আলোচিত হয়েছে।
পরবর্তীকালে বৌদ্ধধর্মের অভ্যন্তরে বা মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে বৈশালী (৩৮৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে), পাটলিপুত্র বুদ্ধদেবে (২৫১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সম্রাট অশোক-এর উদ্যোগে) ও কাশ্মীরে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি আহ্বান করা হয়। কুষাণ-রাজ কণিষ্কের রাজত্বকালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বা শেষ বৌদ্ধ সংগীতির অধিবেশনে বৌদ্ধরা মহাযান ও হীনযান  নামে দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। যে সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধরা নিরাকার বুদ্ধের উপাসনা করতেন তাঁরা হীনযান নামে পরিচিত। যে সম্প্রদায়ভুক্ত বৌদ্ধরা বুদ্ধের মূর্তিপূজায় বিশ্বাসী ছিলেন তাঁরা মহাযান নামে পরিচিত।

নবীনতর পূর্বতন