বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাস

বৈষ্ণব পদকর্তা গোবিন্দদাস



কাব্যাদর্শে বিদ্যাপতি-পন্থী গোবিন্দদাস ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি কোনো সময়ে কাটোয়ার শ্রীখণ্ডে জন্মগ্রহণ করেন তাঁর মাতুলালয়ে। পিতা বিখ্যাত চৈতন্য-ভক্ত চিরঞ্জীব সেন এবং মাতা সুনন্দা দেবী। অল্প বয়সেই তিনি শ্রীনিবাস আচার্যের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। শ্রীজীব গোস্বামীর সঙ্গে তাঁর বিশেষ সখ্য ছিল এবং তাঁর প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তিনিই গোবিন্দদাসকে 'কবিরাজ’ অভিধা প্রদান করেন।

জ্ঞানদাসের মতোই গোবিন্দদাস চৈতন্য পরবর্তীকালের বৈষ্ণব পদাবলি রচয়িতা। চৈতন্য পূর্ববর্তী এবং চৈতন্য পরবর্তী স্তরের বৈষ্ণব পদাবলির মধ্যে আছে প্রভেদ। চৈতন্য পূর্ব বৈষ্ণব পদকর্তাদের কাছে রাধাকৃষ্ণ কোনো আধ্যাত্মিক অনুভবের দ্যোতক পুরাণ প্রতিমা নয়। তারা নিতান্তই প্রেমিক তরুণ-তরুণী। বিদ্যাপতির পদে রাধাকৃষ্ণ মার্জিত অভিজাত যুবক-যুবতি। চণ্ডীদাসের পদে তারা নিতান্ত গ্রাম্য প্রেমিক-প্রেমিকা।

গোবিন্দদাস বিদ্যাপতির মতোই শিল্পকলায় অলংকৃত পদ রচনায় অভ্যস্ত ছিলেন। তিনি বিদ্যাপতি বন্দনা করে দুটি পদ লিখেছিলেন অথচ জয়দেব ও চণ্ডীদাসের বন্দনা করেছেন একটি করে পদে। বিদ্যাপতিবন্দনা প্রসঙ্গে তাঁর প্রার্থনা—
“রসিক শিরোমণি           নাগর নাগরী
            লীলা কি স্ফুরব মোয়।”

তাই বহুকাল আগে থেকেই বিদ্যাপতির সঙ্গে গোবিন্দদাসের তুলনা করা হয়ে এসেছে। স্মরণ করা যায় কবি বল্লভ দাসের একটি পদ—

"ব্রজের মধুর লীলা        যা শুনু দরবে শিলা
        গাইলেন কবি বিদ্যাপতি।
তাহা হইতে নহে ন্যূন      গোবিন্দের কবিত্বগুণ
        গোবিন্দ দ্বিতীয় বিদ্যাপতি।।"

আবার গোবিন্দদাস ও বিদ্যাপতির পদের ভাষার সাদৃশ্যও আছে। কারণ বিদ্যাপতির পদের ভাষা মৈথিলি ও অবহট্ঠ ; গোবিন্দদাসের পদের ভাষা দুই ভাষার আধারে গঠিত কৃত্রিম সাহিত্যভাষা 'ব্রজবুলি'। তিনি গ্রহণ করেছেন ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকের মৈথিলির রূপ—বিদ্যাপতির পদ ওই সময়েই রচিত। তাই উভয়ের পদে আছে ভাষাগত সাদৃশ্য। গোবিন্দদাস অভিসার পর্যায়ের পদে অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী। অবশ্য তাঁর কোনো কোনো পদে সংস্কৃত খণ্ডকবিতা-সঞ্চয়ন ‘কবীন্দ্রবচন সমুচ্চয়' ও রূপ গোস্বামীর ‘পদাবলি'-র ভাষা ভাবের অনুসরণ লক্ষিত হয়। যেমন তাঁর প্রসিদ্ধ—

"কণ্টক গাড়ি            কমলসম পদতল
         মঞ্জীর চীরহি ঝাঁপি৷
গাগরি বারি           ঢারি করি পিছল
        চলতহি অঙ্গুলি চাপি।"

কিছু কিছু পদের ভণিতায় গোবিন্দদাস আপনাকে রাধার সখী রূপে উপস্থাপিত করেছেন। কিন্তু এ থেকে তাঁর 'মঞ্জুরীভাব' বা সখীভাব সাধনার দৃঢ় প্রমাণ বলা যায় না। চণ্ডীদাসও অনেক পদের ভণিতায় নিজেকে রাধার হিতৈষিণী সখী হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। এটি বৈয়বপদাবলির প্রচলিত একটি প্রথামাত্র।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন