সালোকসংশ্লেষ (Photosynthesis)

সালোকসংশ্লেষ (Photosynthesis)

সালোকসংশ্লেষ


সালোকসংশ্লেষ: যে প্রক্রিয়ায় সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে ক্লোরোফিলযুক্ত জীব পরিবেশ থেকে শোষিত জল ও গৃহীত কার্বন ডাই অক্সাইড সমন্বয়ে শর্করাজাতীয় খাদ্য প্রস্তুত করে এবং গৃহীত কার্বন ডাইঅক্সাইডের সমপরিমাণ অক্সিজেন ত্যাগ করে, তাকে সালোকসংশ্লেষ বলে।

সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং প্রকৃতপক্ষে একটি পর্যায়ক্রমিক জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় জল জারিত হয়ে অক্সিজেন মুক্ত করে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড বিজারিত হয়ে কার্বোহাইড্রেট উৎপন্ন করে। সালোকসংশ্লেষ দুটি পর্যায়ে সম্পন্ন হয়। যথা: (১) আলোক দশা ও (২) অন্ধকার দশা।



আলোক দশা

 সালোকসংশ্লেষণের এই দশা আলোক নির্ভরশীল। ক্লোরোপ্লাস্টের গ্রানায় সংগঠিত হয়। এই দশার অবস্থাগুলি—
ক্লোরোফিলের উপস্থিতি: সূর্যালোকের ফোটন কণা শোষণ করে ক্লোরোফিল অণু সক্রিয় ও তেজোময় হয়ে ওঠে। সেই সময় উত্তেজিত ক্লোরোফিল থেকে ইলেকট্রন বিচ্যুত হয়।

ফটোলাইসিস: পাতার ক্লোরোফিল সূর্যালোকের ফোটন কণা শোষণ করে সক্রিয় হয় এবং তা জলকে হাইড্রোজে আয়ন (H⁺ ) ও হাইড্রক্সিল আয়নে (OH⁻) বিশ্লিষ্ট করে। একেই ফোটোলিসিস বলে। বিজ্ঞানী রবার্ট হিল জলের আলোক বিশ্লেষণ প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন বলে এই বিক্রিয়াকে হিল বিক্রিয়া বলা হয়।

NADP (NADPH₂): উত্তেজিত ক্লোরোফিল থেকে বিচ্যুত ইলেকট্রন (e⁻) ও জলের আলোক বিশ্লেষণের ফলে তৈরি হাইড্রোজেন আয়ন (H⁺) কোষের মধ্যে কোত্ৰনজাইম বা হাইড্রোজেন গ্রাহক NADP কে বিজারিত করে, ফলে শক্তিযুক্ত যৌগ NADPH2 গঠিত হয়।
2NADP + 4H⁺ + 4e⁻ —2NADPH₂

অক্সিজেন নির্গমন: ফটোলাইসিসে উৎপন্ন হাইড্রক্সিল আয়ন থেকে ইলেকট্রন (e) বিচ্যুত হয়ে হাইড্রক্সিল মূলক তৈরি হয়। 4 অণু হাইড্রক্সিল মূলক থেকে 2 অণু জল এবং 1 অণু অক্সিজেন উৎপন্ন হয়। এই অক্সিজেন পত্ররন্দ্র দিয়ে পরিবেশে নির্গত হয়।

ফটোফসফোরাইলেশন: সালোকসংশ্লেষের সময় সৌরশক্তি রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত হয় এবং অ্যাডিনোসিন ডাই ফসফেট (ADP) ও অজৈব ফসফেট (Pi) যুক্ত হয়ে উচ্চশক্তিসম্পন্ন অ্যাডিনোসিন ট্রাই-ফসফেট (ATP)-তে আবদ্ধ হয়। সালোকসংশ্লেষের আলোক দশায় সৌরশক্তির প্রভাবে ATP সংশ্লেষের ঘটনাকে ফোটোফসফোরাইলেশন বলে।

অন্ধকার দশা

 সালোকসংশ্লেষের অন্ধকার দশার বিক্রিয়াগুলি উৎসেচকের সাহায্যে ক্লোরোমাস্টিডের স্ট্রোমার মধ্যে সংঘটিত হয়। দশার মূল ঘটনাগুলি হল-

অঙ্গার আত্তীকরণ: সালোকসংশ্লেষের অন্ধকার দশায় কোষের মধ্যে পাঁচ কার্বনযুক্ত শর্করা যৌগ RuBP (রাইবিউলোজ বিস-ফসফেট) গ্রাহক রূপে পরিবেশের কার্বন ডাইঅক্সাইডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে 3 কার্বনযুক্ত স্থায়ী যৌগ PGA (ফসফোগ্লিসারিক অ্যাসিড) তৈরি করে। এইভাবে কার্বন ডাইঅক্সাইড থেকে কার্বনের কোশস্থ যৌগে অঙ্গীভূত হওয়াকে অঙ্গার আত্তীকরণ বলে।
  6CO₂+6RuBP — 12PGA

কেলভিন চক্র: সালোকসংশ্লেষের অন্ধকার দশায় যে পদ্ধতিতে ফসফোগ্লিসারালডিহাইড(PGAID) থেকে রাইবিউলোজ বিস্-ফসফেট (RuBP) সংশ্লেষিত হয়, তাকে কেলভিন চক্র বলে। বিজ্ঞানী কেলভিন প্রথম এই পদ্ধতি লক্ষ্য করেন বলে তাঁর নাম অনুসারে এই পদ্ধতির এরূপ নামকরণ করা হয়েছে। এই সময় ATP পুনরায় ADP তে এবং NADPH⁺ + H⁺ + NADP⁺ তে তৈরি হয়।

সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ার গুরুত্ব:

• সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয় সরল শর্করা গ্লুকোজ, যা শ্বেতসারে রূপান্তরিত হয়ে উদ্ভিদের বিভিন্ন  অঙ্গে সঞ্চিত হয়। গ্লুকোজ থেকে প্রোটিন, ফ্যাট ইত্যাদি অন্যান্য খাদ্যবস্তু সংশ্লেষিত হয়। পরভোজী প্রাণীরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই উদ্ভিদজাত খাদ্যই গ্রহণ করে। তাই সালোকসংশ্লেষের ফলে উৎপন্ন খাদ্যই হল খাদ্যের মূল উৎস।

•   সালোকসংশ্লেষের সময় সবুজ উদ্ভিদ সৌরশক্তিকে শোষণ করে এবং তাকে রাসায়নিক শক্তিতে রূপান্তরিত করে ATP-অণুর মধ্যে আবদ্ধ করে। পরে ওই শক্তি উৎপন্ন খাদ্যের মধ্যে স্থিতিশক্তি রূপে সঞ্চি হয়। শ্বসনের সময় খাদ্যস্থ ওই স্থিতিশক্তি তাপ গতিশক্তি রূপে মুক্ত হয় এবং উদ্ভিদের বিভিন্ন বিপাকীয় কাজে লাগে। পরভোজী প্রাণীরা উদ্ভিদজাত খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করে থাকে।

• জীবকুল শ্বসনের জন্য অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইড পরিত্যাগ করে; ফলে বায়ুমণ্ডলের অক্সিজেনের পরিমাণ কমে এবং কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে। সালোকসংশ্লেষের সময় সবুজ উদ্ভিদ কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ এবং অক্সিজেন বর্জনের মাধ্যমে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে।

• সালোকসংশ্লেষ মানবসভ্যতার অগ্রগতি সালোকসংশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল।‌ ব্যবহৃত অসংখ্য ওষুধ (মরফিন, কুইনাইন, রেসারপিন) সালোকসংশ্লেষের ফলে সৃষ্ট পদার্থ থেকে পরোক্ষভাবে তৈরি ।


সালোকসংশ্লেষের প্রশ্ন ও উত্তর  📌📌 Click


নবীনতর পূর্বতন