বিদ্যাপতি - পদাবলী সাহিত্য

বিদ্যাপতি

বিদ্যাপতি


সূচনা: জয়দেবের ‘মধুর কমল কান্ত পদাবলী’ গীতগোবিন্দকে কেন্দ্র করে মৈথিলী কবি ‘অভিনব জয়দেব’ বিদ্যাপতি পদাবলী সাহিত্যকে ভাবে ভাষায় ছন্দে অলংকারে চিত্রকল্পে বৈচিত্র প্রদান করলেন। পদাবলী সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। বিদ্যাপতির মৈথিলী পদ বাংলা ভাষার সঙ্গে মিশ্রণের ফলে ব্রজবুলি ভাষার সৃষ্টি করে। পঞ্চদশ শতক থেকে বিদ্যাপতির পদ বাংলাদেশের জনপ্রিয় হতে শুরু করে। বিদ্যাপতি তাঁর যাবতীয় সাহিত্য লিখেছেন সংস্কৃত আর মৈথিলীতে। বিদ্যাপতির পাণ্ডিত্য ও কবি খ্যাতির কারণে পূর্ব ভারতের তিনি ‘কবি সার্বভৌম’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। স্বয়ং চৈতন্যদেব বিদ্যাপতির পদ প্রানভরে আস্বাদন করতেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ এবং জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ কাব্যে উল্লেখ পাওয়া যায়।

 জীবন কথা: প্রাকচৈতন্য যুগে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে মিথিলার দ্বারভাঙ্গা জেলার মধুবনী পরগনার অন্তর্গত বিসফী গ্রামে এবং পন্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন বিদ্যাপতি এবং পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে তাঁর তিরোধান ঘটে। এই অঞ্চলটি প্রাচীন ভারতবর্ষে মিথিলা নামে পরিচিত। তাঁদের বংশের কৌলিক উপাধি ছিল ঠাকুর। বিদ্যাপতি ছিলেন মিথিলার রাজ শিবসিংয়ের সভাসদ। বিদ্যাপতি দীর্ঘকাল জীবিত ছিলেন বলে মনে করা হয়। তিনি কীর্তিসিংহ, দেবসিংহ, শিব সিংহের রাজসভার কবি ছিলেন। ১৪১২ খ্রিস্টাব্দে রাজা শিবসিংহ বিদ্যাপতিকে বিসফী গ্রামটি দান করেন। বিদ্যাপতির ‘কীর্তিলতা’র রচনাকাল ১৪০২-১৪০৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্য। এই গ্রন্থে কবি নিজেকে ‘খেলন কবি’ বলেছেন। ‘খেলন কবি’র অর্থ কবির খেলা করার বয়স। চৈতন্য যুগের বৈষ্ণব তিনি ছিলেন না,কারণ তার আবির্ভাব হয়েছিল চৈতন্যদেবের শ'খানেক বছর আগে। উপরন্তু তাঁর রাধা কৃষ্ণ পদাবলী সর্বত্র বৈষ্ণব ভক্তিও ফুটে ওঠেনি। অতএব প্রচলিত অর্থে তিনি বৈষ্ণব ছিলেন না। তাই শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব—মতের প্রতি শ্রদ্ধা ছিল বলে তাঁকে পঞ্চোপাসক হিন্দু (শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব, সৌর ও গাণপত্য) বলেই গণ্য করতে হবে।

বিদ্যাপতির গ্রন্থ: বিদ্যাপতি সর্বমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন।
আনুমানিক ১৪০০  খ্রিস্টাব্দে রাজা দেবসিংহের নির্দেশে ভূগোল বিষয়ক বই ‘ভূপরিক্রমা’ লেখেন।
রাজা কীর্তিসিংহের বীরত্ব কাহিনী কে কেন্দ্র করে অবহট্ট ভাষায় কবি লেখেন ‘কীর্তিলতা’(১৪০২-১৪০৪)।
রাজা শিবসিংহের রাজ ঐশ্বর্য এবং ব্যক্তিগত জীবন প্রণয় তথা জীবনকে কেন্দ্র করে বিদ্যাপতি লিখেছেন ‘কীর্তি পতাকা’(১৪১০) এবং ১৪১০ সালে রাজা শিবসিংহের  রাজত্বকালে বিদ্যাপতি সংস্কৃত ভাষায় লেখেন ‘পুরুষপরীক্ষা’।
সংস্কৃতে পত্র লেখার নিয়মাবলী বিষয়ক বই ‘লিখনাবলী’ বিদ্যাপতি ১৪১৮ খ্রীঃ লেখেন।
১৪৪০-১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে ‘বিভাগসার’ ও ‘দানবাক্যাবলী’ রাজা নরসিংহের নির্দেশ পালন করে লিখেন।
১৪৩০-১৪৪০ খ্রীঃ রাজা পদ্মসিংহের স্ত্রী বিশ্বস দেবীর নির্দেশে বিদ্যাপতি ‘শৈবসর্বস্ববার’ ও ‘গঙ্গাবাক্যাবলী’ রচনা করেন।

ভৈরব সিং এর নির্দেশে কবি রচনা করেন ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী’ (১৪৪০-১৪৬০)।
এছাড়া ‘গোরক্ষোপাখ্যান’ নামে বিদ্যাপতি একটি নাটক রচনা করেন।
বাংলায় বিদ্যাপতি যে সমস্ত পদ পাওয়া গেছে সেগুলির ভাষা বিশুদ্ধ মৈথিলী নয়, তাতে অনেক বাংলা শব্দ অনুপ্রবেশ করেছে, মৈথিলী শব্দের ব্যাকরণ ও অনেক গোলমাল হয়ে গেছে–এই বাংলা-মৈথিলি মিশ্র ভাষার নাম ‘ব্রজবুলি’ দেওয়া। বিদ্যাপতির পদে ব্রজবুলি ভাষার ধ্বনিঝংকারে এবং সুরমূর্ছনায় তাঁর কাব্য বাংলার মাটিতে স্বতন্ত্র এক মাত্রা পেয়েছে। ছন্দলালিত্য, ভাষাসৌন্দর্য, গীতিমাধুর্য এবং ভাব-ব্যঞ্জনার জন্য মিথিলাবাসীর কাছে বিদ্যাপতি ‘মৈথিলী কোকিল’ নামে পরিচিত ছিলেন।

নবীনতর পূর্বতন