চর্যাপদ – বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস
পুঁথি পরিচয়: প্রতিটি তালপাতায় পুরনো বাংলা অক্ষরে লেখা (প্রত্ন বাংলা)। প্রতিটি পৃষ্ঠায় দুই পৃষ্ঠাতেই লেখা। প্রতিটি পৃষ্ঠায় পাঁচটি করে পঙক্তি আছে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত চর্যাপদে মোট সাড়ে ৪৬ টি পদ আছে। পুঁথির যেসব পদ পাওয়া যায়নি-২৩ অর্ধেক,২৪,২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদ। এই তিনটি পদ লুপ্ত হলেও তিব্বতি অনুবাদে তা পাওয়া গিয়েছে এবং তিনটি পদের পদকর্তা যথাক্রমে-কাহ্নপাদ, তান্তীপাদ, এবং কুক্কুরীপাদ। এই পথ গুলির মধ্যে মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৬৯ । মোট পাঁচটি পাতা নেই। লুপ্ত পাতাগুলি বাদ দিয়ে ৬৪টি পৃষ্ঠা পাওয়া যায়। যে পৃষ্ঠাগুলি পাওয়া যায়নি সেগুলি হল ৩৫,৩৬,৩৭,৩৮ ও ৬৬ নং পৃষ্ঠা। প্রতিটি পৃষ্ঠার প্রথম ও পঞ্চম পঙক্তি একটানা লেখা, দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ পংক্তির প্রায় মাঝামাঝি জায়গায় বর্গাকৃতি ব্যবধান আছে, পুঁথির বন্ধন এর জন্য ছিদ্র রাখার উদ্দেশ্যে এই ব্যবধান। পুথিটি শুরু হয়েছে ‘নমঃ শ্রীবজ্রযোগিনৈ’ শব্দ দিয়ে।
পুথির নামকরণ: চর্যাপদ কে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন বলেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর ‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’(১৯১৬) গ্রন্থে। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুথি খানি চর্যাগীতি সংগ্রহের মূল পুথি এবং সেই নাম ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’।
বিধুশেখর শাস্ত্রী নামকরণ করেন ‘আশ্চর্য্যচর্য্যাচয়’।
প্রবোধচন্দ্র বাগচী নামকরণ করেন ‘চর্য্যাশ্চর্য্যবিনিশ্চয়’।
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আবিষ্কৃত তত্ত্বের সূত্র ধরে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যাগীতির যে অনুবাদ সংগ্রহ করেছিলেন তাতে দেখা যায় যে মূল গীতি সংগ্রহের নাম ছিল ‘চর্যাগীতিকোষবৃত্তি’। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে‘হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোহা’ প্রকাশের সময় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যার গীতিটিকে ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু নেপালের দরবার গ্রন্থাগারে রক্ষিত এই পুথি টির প্রথম পত্রের সম্মুখ পৃষ্ঠায় পুঁথির পরিচয় হিসেবে নাগরী হরফে‘চর্যাচর্য্যটীকা’ কথাটি লেখা আছে। অসিত কুমার বন্দোপাধ্যায় নামকরণ করেন ‘চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়’। তিব্বতি অনুবাদ পুথির সূত্রে পুথির যে নাম জানা সেটি ‘চর্য্যাগীতিকোষবৃত্তি’।
চর্যাপদের রচনাকাল: সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (O.D.B.L.) ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যাপদের রচনাকাল দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে। চর্যার আদি কবি লুইপাদ ছিলেন দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বর্ষিয়ান সমসাময়িক। লুই ও দীপঙ্কর মিলে ‘অভিসময়বিভঙ্গ’ নামে বৌদ্ধ তান্ত্রিক গ্রন্থ রচনা করেন। এই তথ্যের সূত্র ধরে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের রচনাকাল দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মনে করেন।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করেন লুইপাদ আদি সিদ্ধাচার্য নন, আদি সিদ্ধাচার্য সরহপাদ। সরহপাদের সময়কাল অষ্টম শতাব্দী। এই তথ্য থেকে তিনি মনে করেন চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী মধ্যে।
মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ভুসুকু ও কাহ্নপাদ কে অষ্টম শতাব্দীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনিও মনে করেন চর্যার রচনাকাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে।
চর্যাপদের পাল রাজাদের রাজত্বের সময় ধরে চর্যাপদের রচনাকাল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে ধরা হয়েছে।
চর্যাপদের কবি পরিচয়: মোট ৫০টি পদে মোট ২৪জন(মতান্তরে ২৩) কবির নাম পাওয়া যায়। পুথিটিতে মূল গানের সঙ্গে মুনিদত্তের টীকা আছে।
চর্যাগীতি সংগ্রহের প্রথম কবি লুইপাদ। তাঁর নামে ২টি পদ পাওয়া যায়। তাঁর নামে অন্যান্য কাব্য পাওয়া যায়- অভিসময় বিভঙ্গ, শ্রীভগবদভিসার ও তত্তস্বভাবদোহাকোষ গীতিকাদৃষ্টিনাম।
বেশি সংখ্যক গান পাওয়া গেছে কাহ্ন নামে(১৩টি)। ভুসুকুপাদের ৮টি,সরহপাদের ৪টি,কুক্কুরীপাদের ৩টি, লুইপাদ শবরপাদ শান্তিপাদ ২টি,অন্যান্যকবির ১টি করে পদ আছে।
চর্যাপদের টীকাকার মুনিদত্ত: মুনিদত্ত চর্যাপদের তিব্বতী অনুবাদের সংস্কৃত টীকাকার। মুনিদত্ত চতুর্থ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। চর্যাপদ সংকলনের তিব্বতি অনুবাদ আবিষ্কার করেন ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচী । মুনি দত্তের সংস্কৃত টীকার নাম ‘নির্মলগিরা টীকা’। মুনিদত্তের পুঁথিতে একান্নটি পদ ছিল। এরমধ্যে ১১ সংখ্যক চর্যার পদটি তিনি রচনা করেননি। তিব্বতি অনুবাদের হিন্দিতে অনুবাদ করে রাহুল সাংকৃত্যায়ন।
চর্যাপদের ভাষা: খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীর কাছাকাছি সময়ে মাগধী অপভ্রংশ থেকে যখন বাংলা ভাষার জন্ম হয় তখন চর্যাগীতিগুলি লেখা হয়েছে। ১৯২৬ সালে ‘The origin and development of the Bengali language’গ্রন্থে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাগীতি ও দোহাকোষের ভাষাগত আলোচনা করে বলেন চর্যার ভাষা আদিমতম বাংলা ভাষায় রচিত।
রাহুল সাংকৃত্যায়ন, কাশি প্রসাদ জয়সওয়াল প্রমূখ হিন্দি পণ্ডিতেরা মনে করেন চর্যার ভাষা প্রাচীন হিন্দি।
ডঃ জয় কান্ত মিশ্র মৈথিলী সাহিত্যের আদি নিদর্শন রূপে চিহ্নিত করেন।
বিজয়চন্দ্র মজুমদারের মতে চর্যার ভাষা হিন্দি।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে চর্যার ভাষা হেঁয়ালিপূর্ণ ভাষা। এই হেঁয়ালি ভাষার নাম সন্ধ্যাভাষা বা সন্ধাভাষা। তিনি সন্ধ্যা ভাষার ব্যাখ্যায় বলেছেন ‘সন্ধ্যাভাষার মানে আলো আ্ঁধারি ভাষা,কতক আলো,কতক অন্ধকার,খানিক বুঝা যায়,খানিক বুঝা যায় না।’