ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ || ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠী:

 ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের লেখকগোষ্ঠী:


ভারতশাসন কার্যে নিযুক্ত তৎকালের বিদেশীয়রা ছিলেন ভারতের ভাষা এবং দেশ সম্পর্কে অজ্ঞ। দেশ ও ভাষার সঙ্গে পরিচয় না থাকলে প্রশাসনের কাজকর্ম ব্যাহত হয়। লর্ড ওয়েলেসলি গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হওয়ার পর এই কর্মচারীদের দেশীয় ভাষা, সাহিত্য, ভূগোল, ইতিহাস, আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞ করে তোলার জন্য বর্তমান লালবাজারে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ (১৮০০ সাল) স্থাপন করেন। বিদেশি শাসকদের সঙ্গে এদেশীয় ভাষা সংস্কৃতির পরিচয় করাতে গিয়ে বাংলা ও অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় যেসব প্রয়োজনীয় পাঠ্যপুস্তক লেখা আরম্ভ হয় তাতেই বাংলা গদ্যচর্চার একটা অনুশীলনের ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়। কাজেই বলা যেতে পারে বাংলা গদ্যসাহিত্যের বিকাশে সহায়তা করেছিল এই শিক্ষাকেন্দ্র। এই কলেজ চলেছিল ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত। তবে ভারতীয় ভাষাচর্চা তথা বাংলা গদ্যভাষার ক্রমোন্নতি আর ইংল্যান্ডে শাসক-কর্মচারীদের শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় এর গুরুত্ব কমে যায়।

ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা, সংস্কৃত আর মারাঠা ভাষা বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় উইলিয়াম কেরিকে। কারণ বাইবেল অনুবাদ করার মাধ্যমে তাঁর ভারতীয় ভাষা অভিজ্ঞতার খ্যাতি পৌঁছেছিল সরকারি স্তরেও।


কেরি কার্যভার গ্রহণের পর পাঠ্যগ্রন্থের অভাবের কথা বুঝলেন। এই অভাব পূরণের জন্য তিনি স্বয়ং লিখলেন দুটি গ্রন্থ বাংলাতেই, 'ইতিহাসমালা' ও 'কথোপকথন'। আর বই লেখার জন্য নিয়োগ করলেন কয়েকজন ফারসি জানা মুনশি। আর সংস্কৃতজ্ঞ পন্ডিতকে নিযুক্ত করলেন পুস্তক-পুস্তিকা রচনার কাজে। রচিত হল মোট যোলোটি বই- (১) 'হিতোপদেশ' (১৮০২), রচয়িতা গোলোকনাথ শর্মা। (২) ঈশপস ফেবলস্-এর অনুবাদ 'ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্ট' (১৮০৩), রচয়িতা তারিণীচরণ মিত্র। (৩) মহারাজ কৃয়চন্দ্র রায়স্য চরিত্রং (১৮০৫), রচয়িতা রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়। (৪) ফারসি তুতিনামার অনুবাদ 'তোতাইতিহাস', রচয়িতা চণ্ডীচরণ মুনশি। (৫) 'হিতোপদেশ' (১৮০৫) রচয়িতা রামকিশোর মুনশি। (৬) মৈথিল কবি বিদ্যাপতির সংস্কৃত 'পুরুষপরীক্ষা'-র অনুবাদ 'পুরুষপরীক্ষা' (১৮১৫), অনুবাদক হরপ্রসাদ রায়। (৭) 'পদার্থতত্ত্বকৌমুদী' (১৮২১)। 'আত্মতত্ত্বকৌমুদী (১৮২২), রচয়িতা কাশীনাথ তর্কপঞ্চানন। (৯) 'রাজাপ্রতাপাদিত্য চরিত্র'। (৮) (১৮০১) ও 'লিপিমালা' (১৮০২) রচয়িতা রামরাম বসু, (১০) 'বত্রিশ সিংহাসন'১৮০২), 'হিতোপদেশ' ১৮০৮), 'রাজাবলি' (১৮০৮) 'প্রবোধচন্দ্রিকা রচনা' (১৮৩৩) রচয়িতা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার। (১১) 'কথোপকথন' (১৮০১)। 'ইতিহাসমালা' (১৮১২) রচয়িতা উইলিয়াম কেরি।

মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার (১৭৬২-১৮১৯) ছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পুস্তক রচয়িতাদের মধ্যে সবচেয়ে সফল গদ্যলেখক। তাঁর গ্রন্থসংখ্যা চার-'বত্রিশ সিংহাসন' (১৮০২), 'রাজাবলি' (১৮০৮) 'হিতোপদেশ' (১৮০৮) এবং 'প্রবোধচন্দ্রিকা' (১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে রচিত হলেও প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে)।


তিনি ছিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত। কিন্তু বাংলা গদ্যের সঠিক রচনারীতি কী হওয়া উচিত সে সম্পর্কে তিনি একটা আদর্শ নমুনা তৈরি করতে পেরেছিলেন। বাংলা গদ্যের যে সাধু রূপটি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখনীতে পরিণতি লাভ করেছিল-তার সূচনা হয় মৃত্যুঞ্জয়ের লেখনীতে।


ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ গদ্য রচয়িতা মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালংকার সংস্কৃতজ্ঞপণ্ডিত হলেও ইংরেজি জানতেন না। তিনি রচনায় সংস্কৃতবহুল বাংলার সঙ্গে জটিলতাহীন সহজ সাধুভাষা এবং স্থানে স্থানে উপভাষারও ব্যবহার করেছেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের এই পণ্ডিত গদ্য রচনার রীতি সম্পর্কে বিশেষ পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন বলেই পরবর্তী বাঙালি লেখকদের কাজ অনেকটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। 

রামরাম বসু (আনুমানিক ১৭৫৭-১৮১৩) সঠিক পরিচয় ও জীবনী জানা যায় না। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের জন্য তিনি দুটি মাত্র বই লিখেছিলেন 'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র'(১৮০১) এবং 'লিপিমালা' (১৮০২)। 

'রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র', বাঙালির লেখা প্রথম মুদ্রিত বাংলা গ্রন্থ এবং গদ্যরচনায় যতিচিহ্নের অভাব ও দূরান্বয়ের মতো নানা ত্রুটি সত্ত্বেও এটি প্রথম বাংলা ঐতিহাসিক গদ্যগ্রন্থ। ভাষায় অপ্রচলিত ফারসি শব্দের আধিক্যও গ্রন্থটির ত্রুটি।


'লিপিমালা'-র ভাষা ব্যাকরণগত দোষ সত্ত্বেও তুলনায় সরল ও সুবোধ্য। বইটি চিঠির আদলে লেখা নানা পৌরাণিক কাহিনির সংকলন।


প্রথম মুদ্রিত বাংলা গদ্য-গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবেই রামরাম বসুর নাম সাহিত্যের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন