বৈদিক যুগ
আর্যদের আদি বাসস্থান নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। কোনও পর্বতমালার পাদদেশে শুষ্ক ও তৃণাবৃত অঞ্চলই হল তাদের আদি বাসস্থান এবং ওই স্থানটি হল উরাল পর্বতের দক্ষিণে অবস্থিত কিরঘিজের তৃণভূমি। এই স্থান থেকে আর্যদের একটি শাখা পশ্চিমে চলে আসে। পরে এই শাখা দু'ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ভাগ ইরানে এবং অপরটি ভারতে প্রবেশ করে। অধিকাংশ পণ্ডিত এ সম্পর্কে প্রত্নতত্ত্ববিদ ব্র্যান্ডেনস্টাইনের মতকে মেনে নিয়েছেন। ব্র্যান্ডেনস্টাইনের মতে, বর্তমান রাশিয়ার অন্তর্গত কিরঘিজ স্তেপ বা তৃণভূমি অঞ্চলই ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি।
আর্যরা ভারতে প্রথম সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। সপ্তসিন্ধু বলতে আফগানিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও উত্তর প্রদেশের পশ্চিম সীমান্ত নিয়ে এক অখণ্ড অঞ্চলকে বোঝায়।
বৈদিক সাহিত্য: বৈদিক সাহিত্য বেদ, সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক, উপনিষদ,বেদাঙ্গ প্রভৃতি নিয়ে গড়ে ওঠেছে।আর্য জাতির প্রাচীনতম সাহিত্য বেদ।‘বেদ’ শব্দটি এসেছে মূল শব্দ ‘বিদি’ থেকে, 'বিদি' শব্দের অর্থ জ্ঞান।বেদ চার ভাগে বিভক্ত। যেমন-ঋকবেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অর্থববেদ। প্রথম তিনটি বো এককভাবে ‘ত্রয়ী’ বা ‘ত্রি’ নামে পরিচিত। প্রতিটি বেদ আবার চারটি খণ্ডে বিভক্ত, যথা— সংহিতা, ব্রাক্ষ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা পদ্যে এবং ব্রাহ্মণ গদ্যে রচিত। আরণ্যক ও উপনিষদ হল বেদের দর্শন বিভাগ। সংহিতায় স্তব-স্তুতি ও মন্ত্রাদি এবং ব্রাহ্মণ অংশে বৈদিক মন্ত্রগুলির টীকা ও যাগযজ্ঞের বিধিগুলি উল্লিখিত আছে।
ঋগবেদ অধিকাংশ পণ্ডিতের ( ১৫০০ থেকে ১০০০) খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে চতুর্বেদের মধ্যে প্রাচীনতম ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল। প্রকৃতির বর্ণনা ও দেবদেবীর স্তুতিগান এই বেদের বিষয়বস্তু। ঋগবেদে দশটি ‘মণ্ডল’ বা বিভাগ ও ১০২৮টি স্তোত্র আছে।
সামবেদের স্তোত্রগুলির অধিকাংশ ঋকবেদ থেকে সংকলিত। এই স্তোত্রগুলি যজ্ঞানুষ্ঠানের সময় সুর করে গাওয়া হত, তাই এগুলি সামগান নামে পরিচিত।
যজুর্বেদ হল যাগযজ্ঞের মন্ত্রাদির সংকলন। ঋক্, সাম ও যজু—এই তিনটি বেদে সংকলিত স্তোত্রগুলিকে ত্রয়ীবিদ্যা নামে অভিহিত করা হয়।
অথর্ববেদে রয়েছে জাগতিক সৃষ্টিরহস্য, চিকিৎসাবিদ্যা ও বশীকরণ মন্ত্রাদি।
আর্য সভ্যতা বেদকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল বলে, এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলা হয়। এই সভ্যতা দু-ভাগে বিভক্ত—ঋকবৈদিক সভ্যতা ও পরবর্তী বৈদিক সভ্যতা।
ঋকবৈদিক সভ্যতা
ঋকবৈদিক যুগের রাজনৈতিক জীবন: ঋগ্বৈদিক যুগে আর্যরা যদু, পুরু, ভরত, সৃঞ্জয়, তুর্বস, অণু প্রভৃতি নানা উপজাতি বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল; প্রতিটি গোষ্ঠীরই স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল। ঋকবেদে সুদাস নামে শক্তিশালী রাজার উল্লেখ রয়েছে।
গোষ্ঠীপতি বা রাজার প্রাধান্য গোষ্ঠীপতি বা রাজার কাজ ছিল উপজাতির জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা, যুদ্ধে নেতৃত্ব দান এবং অপরাধীর শাস্তিবিধান। যুদ্ধে লুঠ করা সম্পদের ভাগ রাজার প্রাপ্য ছিল।
Aaa
ঋকবৈদিক আর্যদের রাষ্ট্রজীবন ও সমাজজীবনের সর্বনিম্ন একক ছিল কুল বা পরিবার, এর ওপরের ছিল গ্রাম, বিশ ও জন। গ্রামের সামরিক ও বেসামরিক শাসনদায়িত্বে ছিলেন গ্রামণী সেনানী রাজাকে যুদ্ধের সময় যুদ্ধ পরিচালনায় আর শান্তির সময় শাসনকাজে সাহায্য করতেন। পুরোহিত শুধু ধর্মীয় দিকই দেখতেন না, যুদ্ধ ও শাসনের ব্যাপারে রাজাকে পরামর্শও দিতেন। ঋকবৈদিক যুগের গণপ্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থাগুলির নাম হল – সভা ও সমিতি। ‘সভা’ বয়োজ্যেষ্ঠদের দ্বারা এবং ‘সমিতি' সর্বসাধারণের দ্বারা গঠিত ও পরিচালিত হত।
ঋকবৈদিক যুগের সামাজিক জীবন:ঋকবৈদিক যুগে পরিবার প্রথা পিতৃতান্ত্রিক ও একান্নবর্তী পরিবার ছিল ঋকবৈদিক সমাজের ভিত্তি পরিবারের সবচেয়ে বয়স্ক পুরুষ হতেন পরিবারের কর্তা, যাঁকে গৃহপতি বলা হত। সমাজে নারীর স্থান ঋকবৈদিক যুগে নারীরা যথেষ্ট সম্মানের অধিকারিণী ছিলেন। ধর্মীয় ক্রিয়াকর্মে, সামাজিক উৎসব অনুষ্ঠানে বিদ্যাচর্চায়, এমনকি যুদ্ধেও অংশ নিতেন। জুঘু, পৌলনী ও কামায়নীর মতো নারীরা ধর্মীয় সাধনায় এবং ঘোষা, অপালা, বিশ্ববারা প্রমুখ বিভিন্ন শাস্ত্রে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ বৈদিক মন্ত্রও রচনা করেছিলেন।
আর্যদের মধ্যে গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণের উদ্ভব হয়। আর্যরা তাদের জীবনকে চতুরাশ্রম নামে চারটি আশ্রম বা পর্যায়ে বিভক্ত করেছিল। এই চারটি পর্যায় হল— (1) ব্রক্ষ্মচর্য অর্থাৎ কৌমার্য রক্ষা করে গুরুগৃহে বিদ্যাচর্চার কাল, (ii) গার্হস্থ্য অর্থাৎ যৌবনে বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালনের পর্যায়, (iii) বানপ্ৰস্প অর্থাৎ প্রৌঢ় অবস্থায় সাংসারিক ব্যাপার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ঈশ্বর-চিন্তার কাল এবং (iv) সন্ন্যাস অর্থাৎ সংসার ত্যাগ করে পরিব্রাজকের জীবন গ্রহণ ও ঈশ্বর চিন্তার পর্যায়।
ঋকবৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবন:ঋক-বৈদিক যুগের সভ্যতা ছিল গ্রামীণ সভ্যতা।কৃষি তাদের প্রধান বৃত্তি ছিল। ক্ষেতকর্ষণ, বীজবপন, জমিতে সার দেওয়া, জলসেচ, শস্য-কাটা প্রভৃতি বিষয়ে তারা দক্ষ ছিল। ঋগ্বেদে এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা আছে। উৎপন্ন শস্যের মধ্যে ধান ও যব ছিল। বাস্তুজমি ও চাষের জমি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছিল এবং গোচারণভূমি ছিল সর্বসাধারণের সম্পত্তি।জীবিকা হিসেবে কৃষির পরেই ছিল পশুপালনের স্থান। তাদের পালিত পশুর মধ্যে ছিল গোরু, মোড়া ও ভেড়া।
এই যুগে নানা নতুন বৃত্তির উদ্ভব হয়। ছুতোর মিস্ত্রির বৃত্তি সম্মানজনক ছিল। তারা যুদ্ধের রথ, নানা যানবাহন, লাঙল তৈরি করত।কারিগরি শিল্প পশম বয়ন, রথনির্মাণ এবং ধাতু ও মৃৎশিল্প ছিল সে যুগের প্রধান কারিগরি শিল্প।
ঋকবৈদিক যুগে স্থল ও জলপথে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত। তবে আর্যরা নয়, অনার্য পণিরা বাণিজ্যে অংশ নিত—প্ৰাক্বৈদিক যুগ থেকেই তারা বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছিল। তবে তখনকার ব্যাবসাবাণিজ্যের পরিধি বিস্তৃত না হওয়ায় ঋকবৈদিক অর্থনীতিকে তা খুব একটা প্রভাবিত করেনি। বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমেই ব্যবসা-বাণিজ্য চলত। গরুও বিনিময়ের মাধ্যম ছিল। ‘নিষ্ক’ও ‘মনা’ নামে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহৃত হত।
ঋকবৈদিক যুগের ধর্মীয় জীবন: ঋকবেদ মুলত একটি ধর্মগ্রন্থ, ঋগবেদ থেকে তাই আর্যদের ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা গড়ে ওঠে।
ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণ, পূর্ণিমা, অমাবস্যা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও জোয়ারভাটা ইত্যাদি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এবং প্রাকৃতিক শক্তি ও দৃশ্যগুলির ওপর দেবত্ব আরোপ করে সেগুলির বন্দনা করত। ঋকবৈদিক ধর্মে পুরুষ দেবতাদেরই প্রাধান্য ছিল, পুরুষ দেবতাদের মধ্যে ছিলেন ইন্দ্র, অগ্নি,বরুণ, সোম, মরুৎ, যম, বায়ু। নারীদেবতারা সংখ্যায় ও গুরুত্বে ছিলেন নিতান্তই হীন। দেবীরা হলেন অদিতি, ঊষা, সাবিত্রী, সরস্বতী।
পরবর্তী ঋকবৈদিক যুগ
রাজনৈতিক জীবন: পরবর্তী বৈদিক যুগে অপেক্ষাকৃত বৃহৎ রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। যেমন—ভরত ও পুরু উপজাতি দুটির সংমিশ্রণে কুরু রাজ্য, তুর্বস ও কিরভিরদের মিলনে পাঞ্চাল রাজ্য এবং শেষ পর্যন্ত কুবু ও পাঞ্চাল রাজ্যের মিলনে বৃহৎ কুরু-পাশাল রাজ্যের উদ্ভবের কথা বলা যায়। এ ছাড়া সে যুগের রাজাদের একরাট বিরাট, সম্রাট, ভোজ প্রভৃতি রাজকীয় উপাধি গ্রহণ এবং অশ্বমেধ, রাজসূয় প্রভৃতি যজ্ঞের অনুষ্ঠান বৃহৎ রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রমাণ দেয়। 'সভা' ও 'সমিতি' নামে ঋগ্বৈদিক যুগের গণপরিষদ দুটির গুরুত্ব হ্রাস পায়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে শাসনকাজে জটিলতা বৃদ্ধির কারণে কয়েক ধরনের নতুন কর্মচারী নিয়োগের প্রয়োজন দেখা দেয়। ঋগ্বৈদিক যুগের গ্রামণী সেনানী, পুরোহিত ইত্যাদি কর্মচারী ছাড়াও এ যুগে আর যেসব কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছিল তারা হল–সংগ্রহিত্রী (কোষাধ্যক্ষ), ভাগদুখ (কর আদায়কারী), সূত (রাজার রথচালক ও ভ্রমণসঙ্গী), ক্ষত্রী রাজ পরিবারের সরকার), অক্ষবাপ (পাশাখেলা বিভাগের অধ্যক্ষ), গোবিকর্তন (রাজার শিকারের সঙ্গী) ও পালাগল (দূত), এ ছাড়া সীমান্ত অঞ্চলের দায়িত্বে প্রপতি এবং একশোটি গ্রামের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন শতপতি।
সামাজিক জীবন: পরবর্তী বৈদিক যুগে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র—এই চারটি প্রধান বর্ণ ছাড়াও বেশ কিছু উপবর্ণের উদ্ভব হয়েছিল। বিবাহের নিয়মকানুনে পরিবর্তন এবং পেশা বা বৃত্তিভিত্তিক কারণেও উপবর্ণগুলির উদ্ভব হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বৈশ্য ও শূদ্রের মর্যাদা হ্রাস বৈশ্যের মর্যাদা কমলেও শুদ্রের অবস্থা হয়েছিল সবচেয়ে করুণ–তাকে অপবিত্র, অস্পৃশ্য বলে মনে করা হত।
পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে ব্রাত্য ও নিষাদ নামে এ দুটি জনগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে। ব্রাত্যরা আর্য, আর নিষাদরা ছিল অনার্য। উভয়েই পশুপালন ও খাদ্যসংগ্রহের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত।
পরবর্তী বৈদিক সমাজে নারীর মর্যাদার হ্রাস হয়েছিল। পারিবারিক জীবনে, ধর্মাচরণে ও বিবাহের নতুন নিয়মকানুনের বাঁধনে তাদের অধিকারকে বিশেষভাবে সংকুচিত করা হয়েছিল। সমাজে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের প্রচলন বেড়েছিল।
অর্থনৈতিক জীবন: পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্য—সর্বক্ষেত্রেই অগ্রগতি ঘটেছিল। এই যুগে গ্রাম ও কৃষিকাজে লোহার তৈরি লাঙলের ফালের ব্যবহার এবং ৬, ৮, ১২ ও ২৪টি ষাঁড়ে টানা ভারী লাঙল দিয়ে চাষ করার ফলে কৃষির উল্লেখযোগ্য সম্প্রসারণ হয়েছিল। এই যুগে উৎপাদিত শসা হল যব, ধান, গম ও তিল। পরবর্তী বৈদিক যুগে কৃষিক্ষেত্রে একটি নতুন মালিকানাভোগী অভিজাত শ্রেণির সৃষ্টি হয়। বৃত্তি জন্মগত হয়ে ওঠায় একশ্রেণির কারিগরের উদ্ভব হয়। এদের মধ্যে কর্মার (কর্মকার), কৌলাল (কুম্ভকার), মণিকার (জহুরি), ইয়ুকার (তির নির্মাতা), ধনুষ্কার (ধনুক নির্মাতা), হিরণ্যকার (স্বর্ণকার) ও রথকার ( রথ নির্মাতা) ইত্যাদির নাম করা যায়। বস্ত্রশিল্পীদের মধ্যে ছিল পশমশিল্পী, রেশমশিল্পী, কার্পাসশিল্পী ও শণশিল্পী। পরবর্তী বৈদিক যুগে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য উভয়েরই প্রসার ঘটেছিল। এ যুগেও ব্যবহৃত স্বর্ণমুদ্রা নিষ্ক এ যুগেও প্রচলিত ছিল।
ধর্মীয় জীবন: পরবর্তী বৈদিক যুগে প্রজাপতি ব্রহ্মা সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হন।
পরবর্তী বৈদিক যুগে কর্মফল ও জন্মান্তরবাদকে নিয়ে নতুন এক দর্শনের জন্ম হয়—এই দর্শন তত্ত্ব অনুসারে মানুষ এ জন্মের কর্মফল পরজন্মে ভোগ করে।